তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ গত বছরের ২৬ নভেম্বর নগরীর কোর্টহিলের অদূরে মেথরপট্টি এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন। সে হিসেবে তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করা সেই খুনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটির বিচার এখনো শুরু হয়নি। পাশাপাশি চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে ১৮ জনের এখনো হদিস পাওয়া যায়নি।
আলিফের সহকর্মীরা বলছেন, এক বছরেও বিচার শুরু না হওয়া এবং মামলার সব আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া দুঃখজনক। আমরা চাইছি, ঘটনায় জড়িত আসামিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করা হোক। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করে মামলার রায় ঘোষণা করা হোক। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক এবং সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলছেন, প্রয়োজনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিয়ে গিয়ে মামলার বিচার করা হোক।
আলিফের সহকর্মী ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের সহকর্মীকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল। সারা বিশ্ব তা দেখেছে। অথচ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি। চার্জ গঠনের আগে যেসব প্রসিডিউর রয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম চলছে বর্তমানে। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছিল। এরপর হুলিয়া ও ক্রোকি পরোয়ানা ইস্যু হয়েছে। আগামী ১ ডিসেম্বর ধার্য তারিখ হয়েছে। সেদিন হয়তো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির জন্য আদেশ হবে। তারপর মামলাটি বিচারে যাবে এবং চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর জন্য আদালত একটি দিন ধার্য করবে। তিনি বলেন, মামলাটির দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ হবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের দাবি, মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হোক।
আদালত সূত্র জানায়, আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলায় গত ২৫ আগস্ট সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাশসহ ৩৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেছে আদালত। কিন্তু আলিফ হত্যা মামলায় পুলিশ চিন্ময়সহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিল। তদন্তে পাওয়া সুকান্তকে সেখানে রাখা হয়নি। তার অব্যাহতি চাওয়া হয়েছিল। এ জায়গায় বাদীর আপত্তি ছিল। কারণ হচ্ছে, সুকান্ত সিএমপির অস্ত্র, মাদক, চুরি ও ডাকাতিসহ ৮টি মামলার আসামি। তদন্ত রিপোর্টেও তাকে দুর্ধর্ষ আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাদীপক্ষ সুকান্তকে চার্জশিটে যুক্ত করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করলে আদালত সেটি মঞ্জুর করে। সেই হিসাবে মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯ জনে।
আদালত সূত্র জানায়, আলিফ হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নগর পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) মো. মাহফুজুর রহমান ১ জুলাই ৩৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিলেন। তারা হলেন চিন্ময় দাশ, চন্দন দাশ মেথর, রিপন দাশ, রাজীব ভট্টাচার্য্য, শুভ কান্তি দাশ, আমান দাশ, বুঞ্জা, রনব, বিধান, বিকাশ, রমিত প্রকাশ রমিত দাস, রুমিত দাশ, নয়ন দাশ, ওমকার দাশ, বিশাল, লালা দাশ, সামীর, সোহেল দাশ, শিব কুমার, বিগলাল, পরাশ, গণেশ, ওম দাস, পপি, অজয়, দেবী চরণ, দেব, জয়, লালা মেথর, দুর্লভ দাশ, সুমিত দাশ, সনু দাস, সকু দাশ, ভাজন, আশিক, শাহিত, শিবা দাস ও দ্বীপ দাশ। এদের মধ্যে চিন্ময় দাশ, চন্দন দাশ, রিপন দাশ, রাজীব ভট্টাচার্য্য, আমান দাশ, বুঞ্জা, রনব, বিধান, বিকাশ, রমিত, রুমিত, নয়ন, সামীর, শিব কুমার, ওম দাস, অজয়, দেবী চরণ, দুর্লভ, সুমিত দাশ, সনু দাস ও সোহেল রানা ঘটনা পরবর্তী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকি ১৭ জন পলাতক। সেই হিসেবে পরে চার্জশিটে যুক্ত হওয়া সুকান্তসহ মোট পলাতক আসামি হচ্ছে ১৮ জন।
আদালত সূত্র আরো জানায়, আলিফ হত্যা মামলাটি হয়েছিল ৩১ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্য থেকে গগন দাশ, বিশাল দাশ ও রাজ কাপুর মেথরকে চার্জশিটে রাখা হয়নি। এ তিনজনের বিষয়ে চার্জশিটে বলা হয়েছে, ঘটনার সাথে এ তিনজনের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাকি থাকে ২৮ জন। এ ২৮ জনের সাথে চিন্ময় দাশসহ ১০ জনকে যুক্ত করে মোট ৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত চার্জশিট দাখিল করেছিলেন। ঘটনার সাথে চিন্ময় দাশসহ এ ১০ জনের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে উঠে আসে। চার্জশিটে সুকান্ত বিষয়ে বলা হয়, মামলার তদন্তকালীন সুকান্ত নামের অপর একজনের নাম উঠে আসে। কিন্তু তদন্তে তার সঠিক নাম–ঠিকানা পাওয়া যায়নি; যার কারণে চার্জশিটে তাকে না রেখে অব্যাহতি চাওয়া হয়।
চার্জশিটে বলা হয়, নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে গত বছরের ৩১ অক্টোবর চিন্ময় দাশের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। দণ্ডবিধির ১২০ (খ)/১২৪ (ক)/১৫৩(ক)১০৯/৩৪ ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছিল। এ মামলায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয়। তার পক্ষের আইনজীবীরা তার জামিন চেয়ে সেদিন একটি আবেদন করেন। সেখানে জামিন নামঞ্জুর হলে তিনি সমর্থকদের উত্তেজিত করেন এবং যে সকল আইনজীবী তার জামিনের বিরোধিতা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে আদালত পাড়ার অদূরে মেথরপট্টিতে খুন হন আইনজীবী আলিফ।
আদালত সূত্র জানায়, আলিফ খুন ও আদালত পাড়ায় ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় মোট সাতটি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালী থানায় ৬টি ও আদালতে একটি মামলা হয়। কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ৭৯ জনের নামে তিনটি, আলিফের বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নামে একটি (হত্যা মামলা) ও তার ভাই বাদী হয়ে ১১৬ জনের নামে একটি ও মোহাম্মদ উল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী ২৯ জনের নামে একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া মো. এনামুল হক নামে একজন বাদী হয়ে ১৬৪ জনের নামে আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হাসান আলী চৌধুরী আজাদীকে বলেন, হুলিয়া ও ক্রোকি পরোয়ানা জারির পর কয়েকটি তারিখ অতিবাহিত হয়েছে। নতুন কোনো পদক্ষেপ নেই। এখনো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। সেই হিসাবে বলা যায়, ধীরগতিতে চলছে মামলার কার্যক্রম। অথচ এ মামলাটি দ্রুত শেষ হওয়া প্রয়োজন। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলার বিচার হতে পারে। এ ট্রাইব্যুনালে মামলাটি নিতে যেতে সরকার আবেদন করতে পারে। অন্যথায় আমরা আবেদন করব। তিনি বলেন, আলিফের প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আগামীকাল (আজ) আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। সেই সাথে স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল হবে।












