আমি তাঁর কবিতা পড়ছিলাম। তিনি কবিতা লিখেন তাঁর মতো করে। নিয়মিত চর্চা ও সাধনায় নিজস্ব ভুবন তিনি তৈরি করেছেন। তাঁর কবিতা নানা সময়ে নানা রূপে এসেছে। কবিতার ভিন্ন ভিন্ন রূপগুলোই অভিন্ন হয়ে ধরা দিয়েছে পাঠকের বোধে। তাঁর ভেতরে যে কবিসত্তা বাস করে, সেটি উজ্জ্বল, অনন্য ও ব্যতিক্রম। তিনি চিন্তায় যেমন আধুনিক, তেমনি তাঁর প্রকাশভঙ্গি সুস্পষ্ট। কখনো ছন্দে, কখনো গদ্যে তিনি তাঁর মনের ভাব, চিন্তা–ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন অবলীলায়। বলেন এভাবে :
তুমি কি তরুণ শিখা নামটি রেখেছ মনে?
যে শিখা জ্বলতে চেয়ে চুরমার মৃত বনে বনে!
আহা কী আহত নদী দিবানিশি জঞ্জালভারে
কারও মনেও নেই নদী খুঁজেছিল কারে!
যে কথা হয়নি বলা তার কথা ভাষা জানে
ভাষার অধিক ভাব তারে ভালোবাসা মানে।
অন্য কবিতায় বলেন :
আমার বছর ঘুরে তোমার বছর ওড়ে
শেষের কবিতা হতে শুরুর কবিতা ঝরে!
যে শিশু জোছনা দেখে দারুণ জীবন শেখে
শিহরিত সে আমাদেরই কালাকাল লেখে।
তিনি কবি নুরুন্নাহার শিরীন। বাংলাদেশের কবিতা অঙ্গনে বিশিষ্ট এক নাম। তাঁর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হই, আলোড়িত হই। দেশের স্বাধীনতার আগে, অর্থাৎ স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি শুরু করলেও তাঁর উচ্চারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে সত্তর দশকের শেষার্ধে।
নুরুন্নাহার শিরীন স্বভাবে শান্ত ও বিনয়ী, চিন্তায় সচেতন, স্বদেশপ্রেমে উজ্জ্বল এবং ভাষায় শাণিত এক কবি। দেশাত্মবোধক কাব্যচর্চায় একনিষ্ঠ তিনি। স্বাধীনতার ইতিহাসকে শব্দে গেঁথে সাহিত্যে করেছেন অমূল্য সংযোজন। তাঁর প্রকাশভঙ্গি সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়। তাঁর কবিতায় তাঁকে এমনভাবে পাওয়া যায়, যেখানে তিনি একাত্ম হয়ে যান বিষয়ের সঙ্গে। নিজেই বলেছেন, ‘কবিতা–সে আদতে অনেক রকম অনুভবের ছন্দিত প্রকাশ বলেই ধারণা। কবিতা সময়েরও উচ্চারণ। ব্যক্তিক বিষয় হতে গভীর প্রেম এবং রাজনীতি অবধি কবিতার বিষয়বস্তু হতেই পারে। কারও কবিতা যখন দেশ–কাল–প্রেমবোধে জারিত হয়ে অনেক পাঠকের হৃদয়ছোঁয়া হয়, তখন সেই কবিতা কালোত্তীর্ণ বলাই যায়। কালিদাসের কাল হতে কবিগুরু, নজরুল, সুকান্ত এবং আজকের নবিস কবিদের হাতেও এভাবেই কবিতা হৃদয়জয়ী হওয়ার ধারাটি ধরে রেখেছে। প্রচুর অকবিতাও রয়েছে বৈকি। কবিতার বই প্রকাশ যত বেশি, তার ভেতর যোগ্য কবিতা তত হাতেগোনা। কবিতা হয়তো সবার না বলেই অসাধারণ অনুভবের পঙ্ক্তিমালা। কবিতাকে এমন ভেবেই আমার যত কবিতা নামের অধরা বিষয়কে লেখার প্রয়াস স্কুলবেলা থেকেই।’ তাঁর প্রায় সমস্ত রচনা আমরা প্রত্যক্ষ করি নানান মাত্রিকতায়। কবিতা ছাড়াও শিশুসাহিত্য রচনাতেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পাশাপশি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংকলন সম্পাদনা।
এ পর্যন্ত ২০টিরও অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : শ্যাওলায় রেখেছি পা, হাওয়ায় হাওয়ায় ঋণ, কাগজের ডানা, ও পাতাল ও মাটি, পাতাভর্তি মেঘ, জেগে আছি জয়োচ্ছ্বাসে, অন্তে আজ কী লেখ্য জানা থাকলে ভালো হতো, পঙক্তিঘোরের খোঁজে (গদ্য), সেতু (বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার নির্বাচিত কবিতা সংকলন, সম্পাদনা), বাতাসের জন্য এলিজি, নমনোকালকাহিনী, পড়েছো জানালাগান?, মা মানে কী জানো? (ছড়া গ্রন্থ), স্বনির্বাচিত, আজও জলছবি পড়ি, নুরুন্নাহার শিরীন এর দেশজ কবিতা, বাংলাদেশের বাজনা (ছড়া গ্রন্থ), একুশের ছড়া ও কবিতা (সম্পাদনা), কবি ও রাজনীতিবিদ অনিল সরকার (সম্পাদনা), নগরনাব্য (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ সংকলন, যৌথ–সম্পাদনা), জীবনপুথি, দেখার দুচোখ জগতজুড়ে (গদ্য)।
নুরুন্নাহার শিরীনের জন্ম কুমিল্লায়, দারোগাবাড়িতে। ১৯৫৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। বাবা কাজী শাহাবুদ্দিন তোহা। মা মাহবুবা খাতুন। স্কুলজীবন শৈলরাণী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। কলেজ জীবন কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে (কুমিল্লা গভঃ ওমেনস কলেজ)। বাংলা সম্মান কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে। ১৯৭৫ সালে বিয়ে। স্বামী নুরুল ইসলাম। শ্বশুরালয় চট্টগ্রামে পটিয়ায়। বর্তমান ঢাকায় অবস্থান করছেন।
তাঁর রচনা থেকে জানা যায়, যখন থেকে তিনি কবিতা পড়ুয়া, তখন থেকেই কবিতার ঘোরের মধ্যেই ডুবে যেতেন। যার মানে হঠাৎ একটি শব্দ একটি লাইন একটি ছবির চিত্রকল্প মনকে তাড়িত করে, মনকে চালিত করে এক পর্যায়ে লিখতে বাধ্য করে। এমন ঘোরকে তিনি নমস্য কবিতার পটভূমি ভাবেন। এমনই এক মুহূর্তে সেই পনের–ষোল–র উড্ডীন বয়সে পড়েছিলেন প্রথম জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। তো কত শতবার পড়েছিলেন নাওয়া–খাওয়া ভুলে তার হিসেব রাখার প্রশ্ন আসে না, সারাবেলা মাথায়–মননে দুই লাইন ঘুরেছে-‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ আর ‘এতদিন কোথায় ছিলেন? আমারে শুধিয়েছে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’ –এই লাইন দুটির সে যে কী অপার গভীরতা সে যে কী চিত্রকল্পময় আর কোনও শব্দে তার ব্যাখ্যা অসম্ভব। সন্ধ্যের গভীর নির্জনতা ঘিরে ধরলে তাঁর তখন নিজেকে বনলতা সেন মনে হতো! তেমন দিনের এক পর্যায়ে বাবার বাড়ির বাগানের ঝোপের লতাগুল্মে ছোট্ট একটা নীলফুল ফুটন্ত দেখেছিলেন। নাম জানা না থাকলেও খেরোখাতায় লিখে ফেললেন–
‘আগাছার ঝোপে ছোট্ট নীলফুল
আমারই বাগানে জন্ম
অথচ আমার কৃতিত্ব নয়–
ওগো ও ছোট্ট নীলফুল
বলো তুমি কি আমার?’
সেদিনের নবীন কবি নুরুন্নাহার শিরীন আজকের প্রতিষ্ঠিত ও কৃতী কবি। তাঁর লেখালেখির জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তবে পাঠকের ভালোবাসাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। বলা চলে, তিনি ভাব ও চিন্তায় যেমন উদার ও আধুনিক; প্রকাশ ও পরিবেশনায় তেমনি সংযত, উচ্চারণে সুস্পষ্ট, তবে উগ্র নন। তিনি লিখেন :
আদতে তেমন কিছুই লাগে না ভাই
মাতৃপিতৃস্নেহচ্ছায়াময় ছাতটুকু লাগে ভাই।
দুই পায়ের তলার মাটি
অই ভিত্তিমূল হতে হয় খাঁটি।
তাই গীতিকার তাই শিল্পী গায়
‘ও ভাই খাঁটি সোনার চে’ খাঁটি’ হৃদি ভেসে যায়।
অশ্রুতকাব্য আমার খুঁজেখুঁজে বেলা বয়ে যায়
অশ্রুতকাব্যে আমার দিবসরজনী ধায়।
সাধনে ভজনে তত ছিল না তো মনোযোগ
জীবনে ভাবিনি তত ভিটেমাটিহীন সংযোগ।
অল্পেই আমার চলে।
অল্পেই আমার চলে।
কেবল কি দোষে আসে মহা রোগশোক
কেবল ভাগ্যের জোরে শুশ্রূষার মহাযোগ।
তাই জীবনভাই আজও আছি
তাই জীবনভাই কৃতজ্ঞচিত্ত বেঁচে আছি।
‘হ্যাঁ, আমাদের এই বেঁচে থাকার জন্যই জগতে এতটা আয়োজন এতটা শিল্পকলা, কবিতা, গল্প, চিত্রকলা ও সংসারযজ্ঞ সামলানো। তার ওপর এক একটি দেশ, রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা। এরপর হাজার রকম জনসাধারণ। এরপর হাজার রকম জীবনযাপন। যা যায়, তা আর আসে না ফিরে জীবনে। কেবল কালের খাতায় স্মৃতিলিপি, কোনও–কোনও দেশজ ইতিহাসলিপি লিখিত থাকে।’ তবে কবি নুরুন্নাহার শিরীন এখন তেমন ভালো নেই। শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। এই রোগশোক নিয়ে অতিক্রম করছেন জীবন। আমরা তাঁর সুস্থতা কামনা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো, বাংলা একাডেমি।












