সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিদেশিদের হাতে। ১৭ নভেম্বর সোমবার ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডের দুই বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকায় চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামে বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একটি মহল এই চুক্তি সমর্থন করলেও আরেকটি পক্ষ শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা এলাকায় লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কের এপি মোলার মায়ের্সক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। অপরদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএ।
চুক্তি অনুসারে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় এ টার্মিনাল নির্মাণের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি বিনিয়োগ করবে। চুক্তিটি স্বাক্ষরের পরপরই ২৫০ কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান পানগাঁও নৌ টার্মিনালটি ২২ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। এ টার্মিনালে মোট ৪ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে মেডলগ। এ ক্ষেত্রে সাইনিং মানি হিসেবে তারা বাংলাদেশকে দিয়েছে ১৮ কোটি টাকা। বিদেশি বিনিয়োগ, গ্রিন পোর্ট নির্মাণ, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিবেচনায় বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি পক্ষ এই চুক্তিকে সমর্থন করছে।
অপরপক্ষ বলছে, বছর খানেক আগে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কোনো সফলতা বা লাভের মুখ দেখাতে পারেনি। চুক্তির বিষয়ে সরকার গোপনীয়তা বজায় রেখেছে চুক্তির শর্ত, দেশ কীভাবে আর কতটা লাভবান হবে; এসব বিষয় প্রকাশ করা হয়নি। পাশাপাশি লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনালের অবকাঠামো নির্মাণ ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এনে সেগুলো বসানো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তিন বছর লেগে যাবে এগুলো ব্যবহারের উপযোগী করতে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সেবার কারণে বাড়তি অর্থও দিতে হবে ভোক্তাকে।
ইতিমধ্যে টার্মিনাল দু’টি বিদেশিদের হাতে তুলে না দেওয়ার দাবিতে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ, মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রামকে অবহেলিত রেখে বাংলাদেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। চট্টগ্রামকে দেশের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা করণীয় তাই করা দরকার। সঠিকভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন হলে চট্টগ্রাম হবে সত্যিকার অর্থে আধুনিক নগরী। কেননা দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে। এই বন্দরকে বাঁচাতে হলে চট্টগ্রামে উন্নয়নের কোনও বিকল্প নেই। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে চট্টগ্রাম দ্রুত এগিয়ে যাবে। দেশেরও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সমস্যা যেখানে সমাধানও সেখানে।
জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি আয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এ কারণেই চট্টগ্রামকে বলা হয় জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। আমদানি–রপ্তানির ক্ষেত্রেও ৮০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। এই চট্টগ্রাম থেকে সরকার যে ট্যাক্স নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে শতকরা ১ শতাংশ দিলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং চট্টগ্রামের উন্নয়নে অন্য কারোর উপর নির্ভরশীলতা আর প্রয়োজন পড়ে না। মাতারবাড়ি টেকনাফ ও মিরসরাই–আনোয়ারাসহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক হাব। তাই চট্টগ্রামকে পিছিয়ে রাখার কোনো কারণ নেই।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে সুপ্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামের রয়েছে এক উজ্জ্বল ইতিহাস। সমুদ্র বন্দরের কারণে চট্টগ্রামকে বলা হতো Gate way of the east, সুপ্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম ব্যবসা বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ব্রিটিশ ভারতে ভৌগোলিক অবকাঠামোগত কারণে চট্টগ্রামে আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার স্থাপন, পাকিস্তান আমলের বৃহৎ শিল্প সমূহ, বহুজাতিক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বাঙালি মালিকানাধীন প্রধান ব্যাংক ও বীমার সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়। তৎকালীন পুর্বপাকিস্তানের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অফিস চট্টগ্রামেই ছিল। ৫০ বা ৬০ দশকে ভারতমুখী আন্তর্জাতিক বিমানগুলো যোগাযোগের জন্য চট্টগ্রাম বিমান বন্দর ব্যবহার করতো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম দেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর। আমদানি ও রপ্তানি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পায়ন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের ফলে অধিকাংশ রাজস্ব আদায় চট্টগ্রামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ অব্দে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বিদেশী পর্যটকদের আগমন, বাণিজ্য এবং যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে আসছে। বর্তমান আধুনিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সময়েও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দেশের প্রধান প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর।
আমরা জানি চট্টগ্রাম, বন্দর নগরী, চট্টগ্রাম বাণিজ্য নগরী, চট্টগ্রাম শিল্প নগরী এবং চট্টগ্রাম বাংলাদেশে সিংহদ্ধার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা এই যে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে চট্টগ্রাম তার আসল সৌন্দর্য হারিয়ে শ্রীহীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। শিল্পনগরী বা বাণিজ্য নগরী বা বন্দর নগরী যে নামে ও অলংকারে ভূষিত হোক না কেন প্রতিটি সরকার চট্টগ্রামকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখেছে। আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কারণে চট্টগ্রাম হয়েছে তার ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত। ভৌগোলিক অবস্থান ও বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দিনে দিনে শিল্পগুলো হয়েছে রুগ্ন। চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহে গ্যাস সংযোগ দিতে সব সময়ে আমলাদের অনীহা লক্ষ্যণীয়। ঢাকায় শুধুমাত্র গাজীপুরে যে পরিমাণ গ্যাসের ব্যবহার হয় চট্টগ্রামের কেজিডিসিএল এ তার অর্ধেক পরিমাণ গ্যাসের সরবরাহ করতে তাদের অনীহা বা ষড়যন্ত্র লক্ষ্যণীয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে আমলারা এবং বিভিন্ন সরকারের শাসনকালে চট্টগ্রামকে এক প্রকার শ্রীহীন করে রেখেছে।
দেশের উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতি জরুরি। কিন্তু দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোন উন্নয়ন জনগণ মেনে নেবে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর। সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার।
দেশের স্বার্থ রক্ষা করে যেকোনো চুক্তি হতে পারে। সরকারকে দেশের মানুষের কাজে এই বার্তা দেওয়াটা জরুরি। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ও উজ্জ্বল হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তা কোনো গোপন চুক্তির মাধ্যমে নয়। স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করা বাঞ্চনীয়। অতীত ও বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো চুক্তির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার একটা পরিবর্তনের জন্য অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এখনো যদি অতীতের একই পথ অনুসরণ করা হয় তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদেরকে অতীতের এই ধারা হতে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে ‘চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। চট্টগ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে এটাই বাস্তবতা।’
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।












