
সাড়ে সাত ঘণ্টার ব্যবধানে আবার ঝাঁকুনি অনুভব করার মধ্যে সেকেন্ডের ফারাকে দুইবার ভূমিকম্পের তথ্য দিয়েছে ঢাকার আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে সেকেন্ডের ব্যবধানে রাজধানীর বাড্ডা ও নরসিংদীর এ দুটি ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবাঈয়্যাৎ কবীর বলেন, ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে একটি এবং ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে। প্রথমটির উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী ঢাকার বাড্ডা। রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটিকে ‘মৃদু’ বলেছে আবহাওয়া অফিস। সেকেন্ডর ব্যবধানে দ্বিতীয়টির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীতে। রিখটার স্কেলে ৪.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটিকে ‘হালকা’ বলা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
এর আগে গতকাল সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে আরেকটি মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যেটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীতে এবং রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। প্রথমে যদিও এর উৎপত্তিস্থল সাভারের বাইপাল বলা হয়েছিল। আগের দিন সকালে তীব্র ভূমিকম্পে পুরো দেশ কেঁপে ওঠার পর এ নিয়ে প্রায় ৩২ ঘণ্টায় তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো। তবে গতকালের দুই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পায়নি ফায়ার সার্ভিস।
ঢাকার ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র দুটি ভূমিকম্প হওয়ার কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বাংলাদেশে একটি ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য দিয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটের এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৩। এটির কেন্দ্র ছিল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। ঢাকার ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রও একই তথ্য দিয়েছে।
অপরদিকে ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমসিএস) বাংলাদেশে একটি ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য দিয়ে বলছে, সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটের এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে আট কিলোমিটার উত্তর উত্তর–পূর্ব দিকে।
এদিকে সন্ধ্যায় ফের রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলাকে কাঁপিয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের ঘণ্টাখানেক পর রাজধানীর ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, কোথাও থেকে কোনো ফোন আসেনি।
গতকাল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনবার ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি অনুভব করার আগের দিনই শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। তাতে তিন জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ছয় শতাধিক মানুষ। ঢাকার বহু ভবনে ফাটল, কোথাও কোথাও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটে। রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীরই মাধবদীতে, কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। স্থায়িত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড। তীব্র ঝাঁকুনির এ ভূমিকম্পের পর এখনই করণীয় ঠিক করতে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলছেন, আজকের ভূমিকম্পটা বলা যেতে পারে ফোরশক। বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট যে ভূমিকম্প, এটা সেগুলোর একটি।
এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা যে রয়েছে, সেটা স্মরণ করে দিয়ে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পন হলে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে। পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ অবরুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভেঙে পড়তে পারে ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকা এড়ানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভবনের মান পরীক্ষা করা, ঝুঁকির ভিত্তিতে সেগুলোকে আলাদা করা এবং নাগরিকদের সতর্ক করাসহ নিয়মিত মহড়া আয়োজনে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার শুক্রবার বলেন, বাংলাদেশ কম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও ঝুঁকির দিক দিয়ে খুব উপরে রয়েছে। যে পরিমাণ শক্তি ইন্ডিয়ান–বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে জমা হয়ে আছে, সেই শক্তিটা যদি বের হয়, তাহলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এটা আগামীকালও হতে পারে, ৫০ বছর পরেও হতে পারে। কখন হবে, সেটা আমরা বলতে পারি না। তবে যেটা হবে সেটা খুব মারাত্মক হবে। সাবডাকশন জোনের ভূমিকম্প ভয়ঙ্কর হয়।
ঢাবিতে হুড়োহুড়িতে আহত ৬ : দেশে তৃতীয় দফায় ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে হুড়োহুড়ি করে নিচে নামতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ছয় শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূকম্পনের সময় তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে শামসুন্নাহার হলে তিনজন, কুয়েত মৈত্রী হলে একজন, বেগম রোকেয়া হলে একজন ও মাস্টারদা সূর্যসেন হলে একজন আহত হন। এর মধ্যে পাঁচজনই ছাত্রী।
ছেলেকে দেখে আবার হাসপাতালে মা : ঢাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম রাফির লাশ গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় দাফন করা হয়েছে। একই ঘটনায় আহত নিহতের মা আছেন হাসপাতালে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ৭২ ঘণ্টার আগে রাফির মৃত্যুর খবর তার মাকে জানানো যাবে না কথা থাকলেও লাশ বেশি সময় রাখা না যাওয়ায় ঘটনার প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর শেষবার ছেলের মুখ দেখে তাকে আবার হাসপাতালে পাঠানো হয়।
গতকাল বাদ জোহর বগুড়া শহরের সূত্রাপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে রাফির জানাজা হয়; পরে বাদ আছর তাকে দাফন করা হয় বলে জানান রাফির মামা নাইহান ইসলাম। এর আগে শুক্রবার সকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালের কসাইটুলীতে একটি ভবনের নিচতলায় মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাফি ও তার মা। ১০টা ৩৮ মিনিটে হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে দোকানের সামনে থাকা ক্রেতাদের ওপর ভবনের ছাদের রেলিং ভেঙে পড়ে। এতে গুরুতর আহত হন ২২ বছর বয়সি রাফিউল ও তার মা নুসরাত। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক রাফিউলকে মৃত ঘোষণা করেন। আর নুসরাত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। রাফি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের : ঢাকাসহ সারা দেশে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশনা দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম। গতকাল মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভূমিকম্পের ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা। সেই সঙ্গে সব দপ্তরকে অবিলম্বে মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশনা দিয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ শেষে তা অবহিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তাৎক্ষণিক একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে, যেখানে ০২৫৮৮১১৬৫১ নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ করা যাবে। ভূমিকম্প নিয়ে কোনো ধরনের গুজব বা বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।












