একই দিনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনকে ভালোভাবে দেখছেন না বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা আগেই বলেছি, নির্বাচনের দিন গণভোট হলে নির্বাচনের জেনোসাইড হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ সময় তিনি ‘নির্বাচন না হলে দেশে সংকট দেখা দেবে’ বলেও মন্তব্য করেন। এছাড়া নির্বাচনে জোট না করলেও অনেকগুলো দল এবং শক্তির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী সমঝোতা হবে বলে জানান। গতকাল শনিবার বিকালে নগরের প্যারেড ময়দানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল ‘জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনকে কীভাবে দেখছে জামায়াত’? উল্লেখ্য, গতকাল এক অনুষ্ঠানে ‘নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে একসঙ্গে আয়োজনে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
এদিকে নগরের আকবরশাহ থানার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া (পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনি) বড় মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে গতকাল চট্টগ্রাম আসেন ডা. শফিকুর রহমান। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার প্যারেড ময়দানে অবতরণ করে। এরপর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর আগামী নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জামায়াতের জোট গঠনের পরিকল্পনা ও পিআর প্রসঙ্গসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘বিএনপি মহাসচিব কারো নাম উল্লেখ না করে বলেছেন একটি দল পিআর নিয়ে নিজেদের সুর নরম করতে শুরু করেছে। আমরা জানি পিআর নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল জামায়াতে ইসলামী। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নিচ্ছি আপনাদের ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে।’ জবাবে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেখেন আমাদের এত পজেটিভ এজেন্ডা, আমরা জাতির জন্য কী করব, কী ভাবছি, সেগুলো বলতে বলতেই আমাদের সময় চলে যায়। কাউকে খোঁচা দেওয়া বা কারো খোঁচার জবাব দেওয়ার সময় আমাদের নেই।
এ সময় পিআর নিয়ে অবস্থান জামায়াতের কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আমাদের দাবি অব্যাহত। এই দাবি বাস্তবায়ন হবে জনগণের স্বার্থে। কথা দিচ্ছি, আমরা ক্ষমতায় গেলে সেই পিআর বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ। আমরা কথা বদলাব না।
‘আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কিনা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কিনা’? এমন প্রশ্নে জামায়াতের আমির বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। কিন্তু এই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আমাদের তৈরি করতে হবে। আমাদের মানে সবাইকে নিয়ে। সবাই তৈরি থাকুন, এ নির্বাচন হতে হবে। এ নির্বাচন না হলে দেশে সংকট দেখা দেবে। আমরা কোনো সংকট তৈরি হতে দেব না ইনশাআল্লাহ।
‘জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় কিনা?’ এ প্রশ্নের জবাবে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এখন স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলছি না, কারণ এটা সম্ভব নয়। আমরা অবাস্তব কোনো দাবি কখনো পেশ করিনি, করবও না।
জামায়াত নির্বাচনী কোনো জোট করবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা এটা ক্লিয়ার করেছি যে, আমরা কনভেনশনাল কোনো জোট করব না। কিন্তু অনেকগুলো দল এবং শক্তির সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী সমঝোতা হবে ইনশাআল্লাহ।
চট্টগ্রামের সব আসনে জামায়াত প্রার্থীর জয়ের জন্য কোনো বার্তা আছে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি চট্টগ্রামের সকল আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়ের কোনো বার্তা দেব না, আমি জনগণের বিজয়ের বার্তা দেব। আমি জামাতের বিজয় চাচ্ছি না, আমি জনগণের বিজয় চাচ্ছি।
এর আগে সাংবাদিকদের ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে এই একটা জেলার নামের আগে বীর শব্দ ব্যবহার হয়। এটার নাম চট্টগ্রাম। অবশ্য বীর চট্টগ্রাম বলা হয় না, বলা হয় বীর চট্টলা। চট্টগ্রামকে আরেকটা উপাধিতে আকৃষ্ট করা হয়, বলা হয় ইসলামাবাদ। ইসলামের আগমন পথ বা ইসলামের গেটওয়ে বাংলাদেশের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, সেই ঐতিহ্যের ধারক আপনারা। মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার ঘোষণাও হয়েছিল এই জায়গা থেকে। এখানে প্রথম কনভেনশনাল লড়াই শুরু হয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই এলাকার একটা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। এই সকল দিক বিবেচনায় বীর চট্টলা যথেষ্ট। এখানকার সাংবাদিকরাও সেই বীরের উত্তরসূরি। বর্তমান দুনিয়ায় কনভেনশনাল ওয়ারের চেয়ে মিডিয়া ওয়ারটা অনেক বেশি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের একটা বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা ৪৭ পার হয়ে এসেছি, ৫২ পার হয়ে এসেছি, ৭১ পার হয়ে এসেছি। এখন আমরা দাঁড়িয়েছি ২৪–এর কোলে। বারবার এ জাতির সামনে সুযোগ এসেছে। কিন্তু সেই সুযোগের উত্তম ব্যবহার যাদের করার কথা ছিল, তারা সেটা না করে সুযোগের অপব্যবহার করেছে। যার কারণে এ অঞ্চল দুই–দুইবার স্বাধীনতার আলো দেখার পরও সেই আলো অনেকটা নিভু নিভু হয়ে গেল।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতার আজ ৫৪ বছর। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় একটা জাতির বহুদূর এগিয়ে যাবার কথা ছিল। আল্লাহতায়ালা আমাদের বহুবিধ সম্পদও দান করেছেন। আর সম্পদের একটা লীলাভূমি এই চট্টগ্রাম, বিশেষ করে বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা জনগণ সেই সম্পদের উপকারভোগী হতে পারলাম না। কিছু লোক জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদের পকেট ভারী করেছে। কিন্তু জনগণ কার্যত সেই রকম কোনো উন্নয়নের মুখ দেখেনি।
জামায়াতের আমির বলেন, শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি আর নতুন করে গ্রো করছে না। এগ্রো বেইজ ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের সাড়া নেই। আমাদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ব্যাপক থাকা সত্ত্বেও চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। এই সবকিছুই হচ্ছে একটাই কারণে। ভিশনারি, আন্তরিক, দেশপ্রেমিক ও সৎ নেতৃত্বের অভাব; এই চারটি উপাদান ছিল না বলে দেশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। সুযোগ এসেছে, হারিয়ে গেছে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা ২০২৪–এর এই সুযোগ আর হারাতে চাই না। ইনশাআল্লাহ এই সুযোগের ষোলআনা সদ্ব্যবহার আমরা করতে চাই। কোনো দলের জন্য নয়, গোটা জাতি, আপামর জনগণ এই দেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সকলের জন্য। আরো যারা আছেন, জাতি–উপজাতি সকলের জন্য। এই বাংলাদেশের সীমানায় যারা বসবাস করে সবার জন্য। এই দেশের শিশু, তাদের মা, এই দেশের বৃদ্ধ, যারা একেবারে অসহায়, আমরা তাদের কথা বলতে চাই। আমরা তাদের কণ্ঠ হতে চাই।
তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে ঘোষণা করেছি, আমাদের যুদ্ধ হবে এ দেশকে সত্যিকারের মুক্তির স্বাদ এনে দেওয়ার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ হবে আপসহীন। এ যুদ্ধে ইনশাআল্লাহ আমরা কারো কাছে মাথা নত করব না। গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। আমরা ইনশাআল্লাহ থামব না। মিডিয়া জাতির দর্পণ, এই যুদ্ধে আপনারাও (মিডিয়াকর্মী) শামিল হবেন। কারণ এই জাতি আমাদের সবার, কোনো বিশেষ দলের নয়।
তিনি বলেন, কারো কাছে আমরা আমাদের রাজনীতি ইজারা দিতে চাই না। কোনো দল নয়, কোনো পরিবার নয়। এদেশের মালিক এদেশের জনগণ। আমরা জনগণের হাতে জনগণের অধিকার তুলে দিতে চাই। দুর্নীতির জট যদি উপড়ে ফেলা যায়, তাহলে সমাজের উন্নয়নের অন্যান্য দ্বারগুলোও খুলে যাবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা ঘোষণা করেছি, আমাদের টপ প্রায়োরিটি হবে ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে তুলে দাঁড়ানো। এই শিক্ষা হবে নৈতিকতা ও আধুনিকতার ভিত্তিতে। সমস্ত আধুনিক সরঞ্জাম এই শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকবে উপাদান হিসেবে। শিক্ষিত মানুষগুলো মানুষ হবে। এখন যেভাবে শিক্ষিত হয়ে মানুষের দুশমনে পরিণত হয়ে যায় ও রকম হবে না। বরং মানুষের দরদি বন্ধু হবে। আমরা মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। আবারও ঘোষণা করছি, আমরা কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করব না। এই মাথা নত হবে শুধুমাত্র রাব্বুল আলামিনের সামনে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান, শাহজাহান চৌধুরী, নগর জামায়াতের আমির নজরুল ইসলাম, উত্তর জেলার আমির আলাউদ্দিন সিকদার, নগর জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন, দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির আনোয়ারুল আলম চৌধুরী, উত্তর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আব্দুল জব্বার, দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা বদরুল হক, নগর জামায়াতের অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা খায়রুল বাশার, মোহাম্মদ উল্লাহ, ফয়সাল মুহাম্মদ ইউনুস, নগর সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম–১০ আসনের প্রার্থী শামসুজ্জামান হেলালী, চট্টগ্রাম–৯ আসনের প্রার্থী ডা. এ কে এম ফজলুল হক, নগর শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি লুৎফর রহমান, নগর ছাত্রশিবির উত্তরের সভাপতি তানভীর হোসেন জুয়েল, দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইমুনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম–৮ আসনের প্রার্থী ডা আবু নাসের ও চট্টগ্রাম–১১ আসনের প্রার্থী শফিউল আলম।












