কেনিয়ান লেখক ও চলচ্চিত্রকার ওয়ানুরি কাহিউ একজন আপাদমস্তক লড়াকু সৈনিক। ২০০৯ সাল থেকে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত আছেন। ‘ফ্রম অ্যা হুইসপার’, ‘পামযি’, ‘ ফ্রম আওয়ার ল্যান্ড’, ‘রাফিকি’র মত সিনেমায় উঠে এসেছে তার সাহসী গল্প বলার ঢং। সন্ত্রাসবাদ, আফ্রোফিউচারিজম কিংবা প্রেমের গল্পনির্ভর এই সিনেমাগুলো আফ্রিকান সিনেমার গালিচায় নারীর শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বকে ভিত্তি দিচ্ছে।
২০১৮ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘রাফিকি’ বিশেষ নজর কাড়ে। সমালোচকদের মনোযোগ এবং পুরস্কারও ছিল ঝুলিতে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পরিবারের দুই কেনিয়ান নারীর সমপ্রেমের গল্পকে ঘিরে এই সিনেমা। যদিও নিষিদ্ধ ঘোষণা আসে কেনিয়ান ফিল্ম ক্লাসিফিকেশন বোর্ড থেকে।
‘রাফিকি’র গল্পের সমান্তরালে আরো একটি আন্দোলন বা বলা যায় বিপ্লবেরও সূচনা করেন ওয়ানুরি। ‘আফ্রোবাবলগাম’ নামক নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করেন তিনি। যার অর্থ হালকা, শান্ত–সাবলীল কিন্তু দৃঢ় মেজাজের শিল্পকর্মকে উদযাপন। ইতিহাসের গভীরে তলিয়ে থাকা মিথ, প্রথা, কুসংস্কারের দিকেও নজর দেয় এই ধারণা। বিশ্বের কাছে ক্ষুধা, দারিদ্রতা, ঔপনিবেশিকতার যে চিত্র তার বিপরীতে আনন্দ, উল্লাস আর ভালোবাসার প্রতিমা দাঁড় করানোই তার লক্ষ্য।
কেনিয়ার বরানা সমপ্রদায় ব্যবহার করে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ক্যালেন্ডার। যা আমাদের বর্তমান ক্যালেন্ডারের প্রায় বারো শত বছর আগের। আফ্রোবাবলগাম–এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ বলা যায়। কারণ এর ভেতরে মিশে আছে আফ্রিকার পুরাণ, বিজ্ঞান ও কল্পনাশক্তির গভীর ঐতিহ্য। চাঁদের উদয়কে কেন্দ্র করে এই ক্যালেন্ডার তৈরি। এখানে সপ্তাহের কোনো ধারণা নেই, তবে মাসের প্রতিটি দিনের রয়েছে একটি করে বিশেষ নাম ও অর্থ। আফ্রোবাবলগাম মূলত সত্য, শক্তিশালী ও সৃজনশীলতার ইতিহাসকেই তুলে ধরে বলে মনে করেন ওয়ানুরি।
‘আমি মনে করি, আমার গল্পগুলো ব্যবহার হবে ভবিষ্যতের কল্পনাশক্তি ও সম্ভাবনার এক ভিত্তি সূত্র হিসেবে’ –ওয়ানুরি কাহিউ
‘দ্য সিঙ্গেল স্টোরি’
অনেকটা চিমামান্ডা আদিচির সুরেই বলা। আফ্রিকার যেন শুধু একটাই গল্প আছে। দুঃখ আর হতাশা। এখানে অসংখ্য গল্প আছে যেগুলো এখনো বলাই হয়নি। যদি বলি ‘দেখাই বিশ্বাস’ তবে নিজেদের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। সহনশীলতার গন্ডি পেরিয়ে নিজেদের দৃঢ় অবস্থানকে জানান দিতে হবে, হয়তো সময়ের সাথে এমনটা বিশ্বাস করা আমাদের জন্যেও জরুরি।
‘কিছুটা গল্প, পুরোটা বিশ্বাস’
যদিও আমার সিনেমা অনেকটা ফ্যান্টাসি নির্ভর কিন্তু লোকে একে আমার নিজস্ব গল্প বলে ভুল করেন। প্রাচীনকালের গল্পকথকের মতই আমি। কেবল নিজের গল্প থেকে বেরিয়ে অতীত এবং বর্তমানের গল্পকে ভাবনায় আনতে চেয়েছি। ভবিষ্যৎ হলো কল্পকাহিনী। আমি মনে করি, আমার গল্পগুলো ব্যবহার হবে ভবিষ্যতের কল্পনাশক্তি ও সম্ভাবনার এক ভিত্তি সূত্র হিসেবে।
‘রাফিকি’র কেনিয়ান প্রেম
কেনিয়া এবং বিশ্ব কি দেখতে পায় আমরা কত সহজ, সাবলীল ভাবে প্রেমে পড়ি? আমেরিকা, এশিয়ার সিনেমার পর্দায় সকলেই তো প্রেমে পড়ছে। আমাদের প্রেম নেই? গল্প নেই? যেন ছুটির দিনগুলো মিস করার মত। প্রেম ও ইচ্ছার সংমিশ্রণ আর ‘জামবুলা ট্রি’ দেখার পরই ‘রাফিকি’ তৈরির চেষ্টা। শুধু প্রেম–ভালোবাসার তুচ্ছ গল্পই বলতে চেয়েছিলাম।
‘দেখা অদেখা বাঁধা’ এবং সেন্সরশিপ
সকলেই আমার সিনেমা দেখবে কিংবা পছন্দ করবে, এটা তো সম্ভব না। প্রথমেই করার মত কাজ ছিল সিনেমাটা বানানো। যখন ‘রাফিকি’ তৈরি করি এবং ক্লাসিফিকেশন বোর্ড একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং অসংবিধানিক হিসেবে আচরণ করে সেন্সরশিপ। কিন্তু আমাদের সংবিধান তো নতুন। কিছু বছর হলো ভোটের রীতি চালু হয়েছে। তাহলে এই সকল আইন খুবই প্রাচীন ঔপনিবেশিক ধারায় চলমান যার আধুনিকায়ন করা হয়নি। এর জন্যে লড়াই প্রয়োজন। অর্থাৎ লোকে যেন সিনেমা তৈরি, দেখা কিংবা প্রদর্শনে ভীত না থাকেন।
‘রঙ এবং মাত্রা’
সিনেমাতে রঙের ব্যবহারও মনের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত ছিল। প্রথমে একদম প্রাথমিক রঙ ব্যবহার করেছিলাম। প্রাথমিক রঙ ব্যবহার করেছি অভিনেত্রীরা যখন একে অপরের থেকে দূরে ছিল তখন। এছাড়া মৌলিক রঙের জন্য নাইরোবি সেরা। শুধু পোশাক দেখলেই বোঝা যায়, কেনিয়াতে রঙের কত মাত্রা আছে এবং কতটা জরুরি অর্থ বহন করে। যখন দুজন অভিনেত্রী একা সার্ভাইব করার দৃশ্য দেখাই তখন সফট প্যাস্টেল পিংক কালার ব্যবহার করেছিলাম। তাদের একাকীত্ব প্রাথমিক রঙের মাত্রা, কেনিয়ার সাথে বিশ্বের যে আলগা পর্দা আছে তারই পরিচায়ক। শুধু অনুভূতির মাত্রাকে গাঢ় রূপ দিতেই শব্দ, গোলযোগ কিংবা ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তকেও রঙে গুলিয়েছি।
‘পামযি’ কল্প–বিজ্ঞানের মিশেল
বোতলে খাদ্য পানীয়’র বিরক্তিকর ব্যবহার দেখেই ‘পমযি’র যাত্রা শুরু। প্লাস্টিকের বোতলে যতটুকু না পানি থাকে তার চেয়ে বেশি পানি নষ্ট হয় এটি বানাতে। আমরা প্রচুর পানি নষ্ট করি। একদিন সব কিছু ফুরিয়ে যাবে। তখন ভাবা শুরু করি, কেমন হবে যখন আমাদের অক্সিজেনও পলিথিনে করে কিনতে হবে? সে প্রশ্ন থেকেই জন্ম পামযি’র।
কেউ কেউ আছে যারা উত্তর না পেলেও প্রশ্ন করে যায়। আশাও এমন এক চরিত্র। যার বসবাস মিউজিয়ামে কিন্তু সে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা রাখে। তাকে স্বপ্ন না দেখার ওষুধ দিলেও সে স্বপ্ন দেখেই যাবে। এরপর প্রশ্ন আসে, আমরা কি প্রকৃতির মা? দায়িত্বশীল? কিংবা কতটুকু ত্যাগ করছি?
‘কালো গল্প’
যখন আমরা আমেরিকান গল্প দেখি, তখন কিন্তু তাকে আমেরিকন গল্প হিসেবে চিহ্নিত করি না। যখনই আমরা লেভেল দেওয়া শুরু করি, তখনই বিচ্ছিন্নতার শুরু হয়। ‘কালো গল্প’ কিংবা ‘আফ্রিকান গল্প’ এই ট্যাগিং এর সাহায্যে আমরা সীমানা নির্ধারণ করি এবং তার উপর ক্ষমতায়নের সুযোগ তৈরি হয়। এটিই আমার কাছে অন্যায় বা কর্তৃত্ববাদের রূপ। যদি গল্পকে শুধুই গল্পের দিক থেকে বিবেচনা করি তাহলে আমাদের পথ সঠিক। কিন্তু বিভাজনের শুরু হলেই প্রশ্ন আসবে এই দায়িত্ব কার? কেন? কেন্দ্র এবং প্রান্তিক কারা? এটি একটি রাজনৈতিক সূত্রও। ‘আদারস’ করে দেখার এই টার্মের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না।
‘নয়া ধারার পুরানা পথ’
আমরা ভূমি সন্তান। জনসংখ্যাতেও ৭৭ শতাংশ অংশ দখলে বলা যায়। আমাদের বেশিরভাগের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। অর্থাৎ আমরা তরুণ এবং সম্ভাবনাময়ী। ফলে আমাদের কাজ যেন ভবিষ্যতের ধারাকে সমন্নুত করার এবং সম্ভাবনার দরজা খুলে তার দিকেই এগিয়ে যেতে হবে। নিজেদের গল্পের সাথে অন্যদের গল্পগুলোকেও যদি দেখার সক্ষমতা তৈরি করতে পারি তবেই আমাদের শক্তিশালী অস্তিত্ব জানান দেওয়া সম্ভব। প্রত্যেক ভিন্ন শ্রেণি, ভাবনা কিংবা প্রেমকে আমাদের সম্মান জানাতে হবে। ভয়কে জয় করার একমাত্র উপায় আনন্দ, কৌতূহল এবং আশাবাদ। ফলে আমি আগাগোড়া একজন আশাবাদী মানুষ।
‘এক দশক পেরিয়ে’
প্রথম আশা, আফ্রিকান চলচ্চিত্রের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ তহবিল ব্যবস্থা হবে। যার বাঁধাধরা নিয়মকে পেরিয়ে আফ্রিকার মানুষের জন্যে হবে, ‘সামথিং আফ্রিকান’ এই ট্যাগিং থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আফ্রিকার চলচ্চিত্র, আফ্রিকারই হবে। মানুষ একে যেমন ভাবে দেখতে চাইবে, সেভাবেই দেখবে। ফলে একমাত্র উপায় থাকবে ‘ধরণ বা স্টাইল’। যেমন সায়েন্স ফিকশন, নাটক, রোমান্স। হ্যাঁ এর বাজার আছে এবং উৎপাদনশীল পণ্যও বটে। শুধু ভূ–রাজনৈতিক অঞ্চলের বেরাকল পেরিয়ে নিজস্ব গল্প, স্টাইল, কাস্টিং, কালার, ব্লকবাস্টার হিট ইত্যাদি কারণেই পরিচিতি পাবে।












