বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের ক্রমবর্ধমান হার নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ, বন্ধুদের প্রভাব, গণমাধ্যমে প্রচারিত সহিংস বিষয়বস্তু এবং স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নেতিবাচক ভূমিকা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ। এতে কিশোর অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ১৮ বছরের কম বয়সী অপ্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম হিসেবে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ তার পারিবারিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আধুনিক কর্মজীবী বাবা–মায়ের ব্যস্ততার কারণে শিশুরা পরিবার থেকে পর্যাপ্ত মনোযোগ পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে শিশুরা পারিবারিক সংযোগের অভাবে স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত ডিভাইসের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এসব অভ্যাস তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এবং অপরাধের দিকে ধাবিত করছে। সামাজিক পরিবেশও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, মাদকের সহজলভ্যতা, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা কিশোরদের অপরাধমূলক কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করছে। রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজে একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে, যা শিশুদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলছে।
গবেষণায় বন্ধুবান্ধব বা সহপাঠীদের প্রভাবকে কিশোর অপরাধের আরেকটি প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বন্ধুরা একটি শিশুর মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন্ধুর নেতিবাচক আচরণ বা অভ্যাস একজন শিশুকে সহজেই অপরাধের পথে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশু বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধূমপানের মতো অভ্যাস শুরু করতে পারে, যা পরে বড় ধরনের অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রচারিত সহিংস বিষয়বস্তু কিশোরদের অপরাধে উদ্বুদ্ধ করার আরেকটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে জনপ্রিয় অনেক অ্যাকশন ফিল্ম বা সিরিজ সহিংসতা, মাদকসেবন এবং ধূমপানের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে।
একালাভিত্তিক গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে যুগের পরিবর্তনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, ‘আমরা মূলত একটা সময়ের ট্রানজেকশনে আছি। সব দেশেই এমন সময় যায়। যখন কিশোর অপরাধ বেড়ে যায়।’ বর্তমান সময়ের কিশোররা উন্নত প্রযু্কি্তর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের দেশের কিশোররা বর্তমানে অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারা এর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং সেই সব সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই জায়গায় তারা ব্যর্থ হচ্ছে। যে সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করতে চাচ্ছে সেটা পুরোপুরি নিতে পারছে না। অন্যদিকে যারা নিচ্ছে তারাও এটার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। যার ফলে সমাজে এর একটা কুপ্রভাব পড়ছে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ।’ তাঁরা বলেন, ‘পারিবারিক শাসন অনেকটাই কমে আসাও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় বাবা–মা দুজনই চাকরি করেন। ফলে সন্তানের প্রতি তাদের যে রোল প্লে করার কথা সেটা হচ্ছে না। এতে করে সন্তানরা সহজে বিপথগামী হয়ে উঠছে।’ একইভাবে কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর পেছনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কমে যাওয়াকেও দায়ী করছেন তাঁরা এবং বলেন, ‘এখন এলাকা ভিত্তিক সামাজিক কার্যকলাপ নেই বললেই চলে। যা আছে তাতে কিশোরদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ খুব কম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না, খেলার মাঠ কমে এসেছে। সামাজিকভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন না থাকায় কিশোররা সাইবার জগতে বুঁদ হয়ে আছে। তারা সেখান থেকেই যা শিখছে তা প্রয়োগ করতে গিয়ে বিপথগামী হচ্ছে। এই প্রযু্কি্তর শুভ ব্যবহার আমরা তাদের শেখাচ্ছি না। ফলে অপরাধ বেড়ে চলছে।’ তাঁরা বলেন, পরিবার থেকেই নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মোবাইল ফোন বা প্রযুক্তি ব্যবহার করার দরকার হলে খেয়াল রাখতে হবে যেন নিষিদ্ধ কোনো অ্যাপস ব্যবহার না করে। আমাদের দেশে সব আইনে শিশুদের সব ধরনের শাস্তি মওকুফ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিশু–কিশোর অপরাধীকে সংশোধন করতে হবে। শিশু–কিশোররা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের শিক্ষা–দীক্ষায় বড় করে তুলতে হবে। তাদের সব ধরনের অপসংস্কৃতির বাইরে রাখাও একান্ত জরুরি। শিশু–কিশোরদের জন্য সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।







