ইছামতী খাল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় অবস্থিত। অবশ্য দেশে বেশ কিছু ইছামতী নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে রাঙামাটি অংশের ইছামতী নদী হিসেবে পাওয়া যায় ইছামতীকে। ইছামতী বর্ষা মৌসুমে পাড়ের মানুষগুলোকে আক্রমণ করে বসে। কারো ঘর নিয়ে যায়, কারো ভিটা–বাড়ি। কেউ ঘর বাড়ি ছাড়া হয়ে অন্যত্র চলে যায়। কেউ পাহাড়ে কেউ সমতলে। এতে করে ইছামতীর ইতিহাসে বিপুল পরিমাণ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটে। এখন সেই আগের ছোট খাল নেই। এখন ইছামতীর কোথাও কোথাও কর্ণফুলী নদীর উপরের কাপ্তাই অংশের মত হয়ে গেছে আকারে। তাই কেউ কেউ নদী বলে ইছামতীকে। ইছামতী খাল হোক কিংবা নদী হোক, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইছামতী পরিচিতি। ব্যবসায়িক কারণে কিংবা আত্মীয়তার সুত্রে এই পরিচিত রাংগুনিয়া ছেড়ে যায়।
রাঙামাটির রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। তিনি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগরে তাদের পুরাতন রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে– ১. রাজার হাট টু রানীর হাট ২. রাজার হাট টু ধামাইর হাট ৩. রাজার হাট টু আলম শাহ পাড়া ৪.রাজার হাট টু ঘাটচেক বা রোয়াজার হাট, এই চারটি সড়ক গত ফোর এলায়েন্স গভর্নমেন্টের আমলে জাপানের সহযোগিতায় এক সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশ সরকার। এরই অংশ হিসেবে রাজবাড়ির পিছনে ইছামতীর উপর নির্মিত হয় সেতু। যদি নিয়মিত বালু মহাল ও ইজারা দেয়া হয় তবে এই ব্রিজটিও শঙ্কামুক্ত নয়। এরই মধ্যে সেতুর পশ্চিম পাশে বালু ইজারা দেয়া হলে বিপুল পরিমাণ বালি উত্তোলন হয়। বালু উত্তোলন ও ইজারা চলমান রয়েছে। সেতুটির পশ্চিমে খালের বাঁক অংশ ভেঙে গেলে রাজার হাট পর্যন্ত ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। রাজারহাটের বাজার মসজিদটি নেই। মসজিদটি খালে ভেঙে গেছে। ইছামতীতে রাঙামাটি সড়কে রাণীর হাট সেতু, কাপ্তাই সড়কে রোয়াজার হাট সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে চলাচল হয়। এতে কাপ্তাই ও রাঙামাটির যাত্রীদের চলাচল করতে হয়। দেখা যায়, রোয়াজার হাট সেতুর পরে ইছামতী খাল কর্ণফুলী নদীর আকার ধারণ করেছে। এর একটু পরেই মোহনায় মিলেছে ইছামতী ও কর্ণফুলী।
২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের আগে বালু ইজারার কারণে যত্রতত্র বালু উত্তোলনের ফলে ইছামতীর বেশি ক্ষতি হয়। ৫ আগস্টে সরকার পতন হলে ইজারা নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়। ইজারায় বালু উত্তোলনের লোকজন হারিয়ে যায়। ফলে নতুনদের আগমন ঘটে। রাতারাতি বালু তুলে কেউ কেউ হঠাৎ শূন্য থেকেই ওঠে যায়। যত্রতত্র অবৈধ বালু উত্তোলনের হিড়িক পড়ে যায়। বালু নিয়ে ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়। কোথাও কোথাও রাতে এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের গুলি বিনিময় হয়। ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী গেলে পক্ষগুলো সরে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সারাদেশের মত ইছামতীও সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে যায়। কেউ কারো কথা শোনার মানসিকতায় ছিল না। অনেকেই বালু উত্তোলনের উৎসবে যোগ দেয়। কেউ নিষেধ করার চেষ্টা করলে বিপরীত পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার আসে। এ সব কারণে ইছামতীর পাড়ের মুরব্বি শ্রেণির লোকজন ইছামতী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিজেদের বসতি ও নিরাপত্তা মহান স্রষ্টার ওপর ছেড়ে দেয়। ফলে ইছামতী আরো সংকটে পড়ে। তাতে আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ে ইছামতী।
প্রশাসনের এ্যাকশনের ফলে ২০২৫ সালের শুরু থেকে ইছামতীতে যত্রতত্র সাধারণ মানুষ বালু তোলার সাহস করে না। অবৈধ বালি উত্তোলন করলে উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে অন্তত ইছামতী কিছুটা হলেও নিরাপত্তা পেয়েছে। তবু বালু মহাল ও ইজারা অব্যাহত থাকায় ইছামতী ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইছামতীকে রক্ষা না করলে ইছামতী রক্ষায় পূর্ণতা আসে না। প্রয়োজন ব্লক স্থাপন। প্রয়োজন টেকসই কার্যক্রম। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল, বালু উত্তোলনের কবলে পড়ে ইছামতীর কোথাও কোথাও বালু তুলে খালের তলদেশ মাটি অংশে পৌঁছে গেছে। ইছামতী ভাঙনের পুরো বিষয়টি জানতে হলে এবং পুর্নাঙ্গ সঠিক সমাধান বিষয়ে ভাবতে হলে আমার অনুসন্ধানী কলাম ‘ইছামতী খাল : ভাঙন প্রতিরোধে করণীয়’ সম্পাদকীয় পাতা, দৈনিক আজাদী, প্রকাশ– ৪ জুলাই ২০২৪ তারিখের লেখাটি সংগ্রহ করতে পারেন। এরপরও কিছু করণীয় তুলে ধরা হল– ১. ড্রেজিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যতিত বালু মহাল ও ইজারা না দেয়া। ২. সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে দায়িত্ব পালনে সরকারি যথাযথ নির্দেশনায় (লিখিত) জোর দেয়া। ৩. ভাঙন কবলিত এলাকায় ব্লক স্থাপন অব্যাহত রাখা। ৪. অবৈধ বালু উত্তোলনে আইনি ব্যবস্থায় জোর দেয়া।
আশা করি উপরোক্ত সুপারিশ সারাদেশের নদী, খালের জন্যে প্রযোজ্য হতে পারে। তাতে নদী, খাল ভাঙনের কবল থেকে মুক্ত হয়। ভিটা–মাটি হারানো মানুষের সংখ্যা কমে আসে। বাস্তুচ্যুতি হ্রাস হয়। অবশ্য গত সরকারের আমলে ইছামতীর বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্লক হয়েছে। তবে যে সমস্ত এলাকায় ব্লক হয়নি সে সমস্ত এলাকার মধ্যে কিছু কিছু অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। দুই পাড়ে শুষ্ক মৌসুমী চাষাবাদের লক্ষ্যে পারুয়া কাটাখালি এলাকায় রাবারড্রাম স্থাপিত হয়। এই রাবার ড্যমের সুরক্ষা প্রয়োজন। রাজার হাট টু মোগলের হাট সড়কটি প্রথমবারের মত কার্পেটিং হয়েছে। এই সড়কটি উত্তর রাংগুনিয়ার ইতিহাসে প্রধান ও প্রথম সড়ক ছিল রাজাদের আমলে। এ সড়কের রাজারহাট থেকে বাদামতলি অংশ যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। যেহেতু এখানে ব্লক বসানো হয়নি। তাই খালের গর্ভে চলে যেতে পারে এ অংশ। তাতে চলাচল রুদ্ধ হয়ে যাবে। তেমনি রাণীর হাট এলাকার কিছু অংশে। পৌরসভা, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, পারুয়া, হোসনাবাদ, ১৪ নং দক্ষিণ রাজানগর, লালা নগর, ১ নং রাজা নগর ইউনিয়নসমুহের অংশে ইছামতী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিকার দরকার। ইছামতীর মানুষ নিরাপদ হোক। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাতে আমাদের প্রিয় ইছামতী রক্ষা পায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মী












