নবান্ন উৎসবের ঋতু হেমন্ত

রাহেলা আক্তার | বুধবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২৫ at ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ

ঋতুচক্রের পরিক্রমায় বঙ্গ ঋতুনাট্যে হেমন্ত চতুর্থ ঋতু। শরতের পরে শূন্যতা, রিক্ততা ও বিষন্ন প্রকৃতির মেদুরতাহীনতায় আবিভূত হয় হেমন্ত ঋতু। প্রত্যেক ঋতুর আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতি নবনব সাজে সজ্জিত হয়। শরতের শেষ প্রহর থেকেই বাতাসে মৃদু গুঞ্জন তোলে হেমন্তের রৌদ্রাঙ্কিত মোহনীয় নিবিড় তরঙ্গ। সবুজ শ্যামল জমিনে এখন শোভা পাচ্ছে সোনালি বর্ণের উজ্জ্বলতর হেমন্তের আলোক রেখা।

ধান ও ঘাসের ডগায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে হেমন্ত। শিশির বিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর। এভাবেই প্রকৃতিতে হেমন্তের আগমন উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। রৌদ্রখর তপ্তদাহ উপেক্ষা করে যে কৃষক ফলিয়েছে সোনা ধান। ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে তার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তির নির্মল হাসি। রৌদ্রোজ্জ্বল আভার প্রকৃতি মানেই হেমন্ত। হেমন্তকে বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। শিশিরস্নাত সকাল কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম দুপুর। পাখির কলকাকলী ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে

জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকে যেনো আরো রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। হেমন্তের এ মৌনতাকে ছাড়িয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে।মানুষের জীবনে এনে দেয় সর্বজনীন উৎসবের ছোয়া। হেমন্তকে বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু।হেমন্তের শিশিরঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি আর কামিনী। হেমন্তের দিঘির জলে, বিলে,ঝিলে ফোটে কতনা রঙের পদ্মা। হেমন্তের চরিত্র আর তার বাইরের রূপ জগতজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে শত শত গল্প, শিল্প, গান ও কবিতা। অসাধারণ সৌন্দর্য চেতনায় ভাবুক হৃদয়ের বিলাসিতায়।

বাংলাদেশ গ্রামভিত্তিক কৃষি প্রধান দেশ। তাই কৃষক, কৃষিপণ্য,কৃষকের জীবনাচরণ আধুনিক বাংলা কাব্যের একটি বড় অনুষঙ্গ। আর হেমন্ত ঋতুতেই এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই, ভেবে অবাক লাগে। কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে, তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাঁথা বাংলা কবিতায় এরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য,পূর্ণতা,বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত। কবি জীবননান্দের কাব্যে নানান ভাবে তুলে ধরেছেন হেমন্তের নানা রূপ। জীবননান্দের কাব্যে যখন রূপান্তর ঘটছে, হেমন্ত তখনো তার উপকরণ হয়েছিল। হেমন্ত তার চোখে কেবল রূপসজ্জা ও সৌন্দর্যের জৌলুস মাত্র নয়। হেমন্ত তার কাছে প্রেম বিরহ মিলন ও সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়।

হেমন্তের অন্য নাম নবান্ন, এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত।নবান্ন মানেই চারদিকে পাকা ধানের মৌ, মৌ গন্ধ। গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম।হেমন্তের এ ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। গাছিদের খেজুর রস নামানো,সন্ধায় খেজুর গাছে হাঁড়ি বসানো। ভোরে শিশির মাখা গায়ে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনা।গৃ্‌হস্থবাড়িতে নতুন ধানে পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গ্রাম বাংলার অনবদ্য রূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ কবি সুফিয়া কামাল। পল্লী প্রকৃতির সহজ সরল ও স্বাভাবিক রূপ তার কাব্যে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। আবার কখনো তিনি হেমন্তকে চিঠি লিখে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে আবিভূত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সবুজ পাতার খামের ভেতর

হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে

কোন পাথরের ওপার থেকে

আনলো ডেকে হেমন্তকে?

বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। নতুন ধানের আগমনে কৃষকের গলায় ধরে আনন্দের গান। আর ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা বলা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘুম স্বপ্নে
পরবর্তী নিবন্ধপাঠানটুলি ওয়ার্ডে মহিলা সমাবেশ