আমাদের দেশ থেকে দিনে শত শত নর–নারী ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করতেছেন। হজের ১ লাখ ২৭ হাজার আমাদের দেশের কোটা থাকলেও গত বারে হজ করছেন প্রায় ৮৭ হাজার। ওমরাহ করতে গেলে এবং হজের পর হাজীদের মধ্যে অধিকাংশ মন থেকে তাড়িত হয় তায়েফ গমন করতে। আগে তায়েফ গমনে বিধি নিষেধের কারণে গমন অনেকটা বন্ধ বলা যেত। এখন খুবই সহজ। পবিত্র মক্কা থেকে মাত্র ১ শত কি.মি কম বেশি দূরত্বে পর্বতরাজীর উপর তায়েফ মহানগর। পবিত্র মক্কা থেকে তায়েফ গমনের জন্য একাধিক সড়ক রয়েছে। তেমনিভাবে রিয়াদ থেকে আসার জন্য রয়েছে ঐদিকে পৃথক সড়ক। পবিত্র মক্কা ও জেদ্দা থেকে যেতে সৌদি সরকার দু’টি সড়ককে অনেকটা মহাসড়কে উন্নিত করা হয়। পবিত্র মক্কা থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর জেদ্দা থেকে আসা সড়কের সাথে মিলতে হয়। অতঃপর তায়েফ গমন। পর্বতশীর্ষে শহর বিধায় মে–জুন–জুলাই–আগস্ট অতীব গরমেও তায়েফে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ আবহাওয়া মনোরম। ডিসেম্বর জানুয়ারী মাসে আবহাওয়া ভেদে বরফ পড়ে।
তায়েফ কেন্দ্রীক রয়েছে দু’টি মিকাত। এক. কারনুল মানাযিল আরেকটি হল ওয়াদি মাহরাম। আল্লাহর রসূল (স.) পাঁচটি মিকাত প্রবর্তন করে গেছেন। পবিত্র কাবার সম্মানার্থে হযরত জিব্রাইল (আ.), হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে পবিত্র কাবার বৃহত্তর এরিয়া তথা হারমের সীমানা নির্ধারণ করেন। আল্লাহর রসূল (স.) পবিত্র কাবার সম্মানার্থে আরও অনেক দূরে পাঁচটি মিকাত নির্ধারণ করে দেন। পবিত্র মদিনা থেকে আসতে পবিত্র মক্কা থেকে চার শত কি.মি উত্তরে যুল হুলায়ফা মিকাত। মিশরের দিক থেকে আসতে পবিত্র মদিনার প্রায় এক শত কি.মি দক্ষিণ পূর্বে জোহফা বা জাহফা মিকাত। জেদ্দা থেকে প্রায় ৪০/৫০ কি.মি দক্ষিণে লোহিত সাগর থেকে প্রায় ২০ কি.মি পূর্বে ইয়ালামলাম মিকাত। আমাদের উপমহাদেশ থেকে সাগরপথে হজে গমন করতে ইহায় ছিল মিকাত।
পবিত্র মক্কা থেকে ৮০/৯০ কি.মি উত্তরে জাতে ইরক। এই মিকাত পাহাড়–পর্বত এরিয়ায়। সম্প্রতি সৌদি সরকার গুরুত্ব দিয়ে এই মকামে অবকাঠামো নির্মাণ এবং যাতায়াতে রাস্তার কাজ চলমান। পবিত্র মক্কা থেকে তায়েফ প্রবেশের কিছুটা আগে কারনুল মানাযিল মিকাত।
পবিত্র মক্কা থেকে সৌদি সরকার দু’টি রাস্তাকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করে। ওমরাহ ও হজযাত্রীর কল্যাণে অপর মহাসড়কেও কারনুল মানাযিলের সমান্তরালে আরও একটি নতুন মিকাত প্রতিষ্ঠা করে। নাম দেয় ওয়াদি মাহরাম।
আল্লাহর রসূল (স.) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তায়েফ গমন করেছিলেন। তথাকার বিধর্মী জালেমরা আল্লাহর রসূল (স.)কে কষ্ট দেয়। এক স্থানে বিশ্রাম নিলে এই জালেমদের একটি অংশ পাহাড়ের উপর থেকে একটি বিশাল পাথর আল্লাহর রসূল (স.) এর দিকে নিক্ষেপ করে। মহান আল্লাহ পাকের মহিমা ঐ পাথর মাঝখানে থেমে যায়।
আল্লাহর রসূল (স.)’র দুধ মা হালিমার বাড়ি তায়েফ থেকে ৫০/৬০ কি.মি দূরত্বে। এখানে আল্লাহর রসূল (স.) জন্মের পর শিশুকাল অতিবাহিত করেন। আল্লাহর রসূল (স.)’র আমলে মহান যুবক সাহাবা তিন আবদুল্লাহ বহুমুখী যোগ্যতায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। যথা–
১. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস: হযরত আব্বাস (র.) আল্লাহর রসূল (স.)’র আপন চাচা এবং সমবয়সী।
২. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর: যিনি আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.)’র পুত্র
৩. আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর: তিনি আসরায়ে মোবাসশরা তথা জীবিত অবস্থায় জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। হযরত আবদুল্লাহর মা হযরত আসমা হযরত জুবাইরের স্ত্রী, মা আয়েশা ছিদ্দিকার বড় বোন, হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.)’র কন্যা।
আল্লাহর রসূল (স.)’র ওফাতের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস তায়েফকে গুরুত্ব দেন। এখানে তিনি কর্মজীবন কাটান। এক বর্ণনায় সহায় সম্পত্তি ছিল। তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ হল আব্বাসী মসজিদ। এই মসজিদ সংলগ্ন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস শায়িত।
আমাদের দেশের হজ ও ওমরাহকারীরা এহরামের প্রস্তুতি নিয়ে পবিত্র মক্কা থেকে যাওয়া–আসা রিজার্ভ গাড়ি ঠিক করে কয়েক ঘণ্টার জন্য তায়েফ গমন করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে কাফেলা এজেন্সীরাও তাদের আওতাধীন হজ ওমরাহকারীদেরকে তায়েফ পাঠাতে সহযোগতিা করছে।
হজের পর আমাদের দেশের হাজীরা জেদ্দা গমন করতে অতীব উৎসাহী থাকতেন। সাম্প্রতিককালে তায়েফও যোগ হয়। বর্তমান সৌদি সরকারের অঘোষিতভাবে গরমকালের রাজধানী হল তায়েফ। সেই লক্ষে তায়েফ বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নিত করা হয়েছে। তায়েফ সৌদি আরব ও ইয়েমেনের আল–শারাহওয়াত পর্বতরাজীর একটি অংশ। এই পর্বতরাজী তায়েফ থেকে আবাহা হয়ে ইয়েমেনের রাজধানী সানা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সানাও শৈল শহর। তথা পর্বতরাজীর শীর্ষে ইয়েমেনের রাজধানী। সৌদি আরবের অংশ আবাহাও সমৃদ্ধ। এখানেও সৌদি আরবের বড় বড় শেখদের দ্বিতীয় প্যালেস রয়েছে। রয়েছে বিমান বন্দর। বৃহত্তর তায়েফ কয়েকভাবে বিভক্ত। মূল তায়েফের সাথে আল হাদাসহ কয়েকটি অংশ রয়েছে। আল হাদায় ক্যাবলকারসহ শেখদের অসংখ্য প্যালেস রয়েছে। সৌদি আরবের বর্ণনা মতে তায়েফের আয়তন ১৬২৩ বর্গ. কি.মি। তায়েফের উচ্চতা ১৮৭৯ মিটার তথা ৬১৬৫ ফুট।
বাদশাহ ফয়সল ১৯৬৫ সালে প্রায় ৮৭ কি.মি দীর্ঘ মাউন্ট হাইওয়ে হিসাবে এই সড়ককে উন্নত করেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তায়েফের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তায়েফকে সৌদি আরবের শস্য ভান্ডার বলা হয়। এখানে শাক সবজির পাশাপাশি নানান ফল–ফলারের জন্য খুব প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে নানান প্রকৃতির আঙ্গুর, নাশপাতি, আনার তথা বিশ্বে এমন ফল কম পাওয়া যাবে, যা তায়েফে উৎপাদন হয় না। এখানে রয়েছে বিশাল বিশাল ফলের বাগান। আমাদের দেশের অনেক প্রবাসী এখানে কর্মরত।
আল্লাহর রসূল (স.) পবিত্র মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন অতঃপর তায়েফ ইসলামের ছায়াতলে আসে।
যুবরাজ ফয়সল ১৯২৪ সালে এই তায়েফ থেকে তাদের রাজকীয় বাহিনী নিয়ে শরীফ হোসাইনকে হটিয়ে পবিত্র মক্কার নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর জেদ্দা অতঃপর পবিত্র মদিনা।
১৫১৭ সালে তুর্কি সুলতান প্রথম সেলিম পবিত্র মক্কার পাশাপাশি তায়েফও নিয়ন্ত্রণে নেন। তায়েফ দখল নিয়ে তুর্কি সুলতান ও সউদবংশের মধ্যে নানান ঘাতপ্রতিঘাতের ইতিহাস রয়েছে।
১৮৪৩ সালে তুর্কি সুলতানেরা তায়েফে দুর্গ এবং মিলিটারী ব্যারাক পূর্ণ নির্মাণ করেন। ১৮৬৯ সালে সরকারী একাধিক ভবনও নির্মাণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ও আরব বিদ্রোহের কারণে তায়েফে তুর্কি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। তেমনি দুর্বল হয়ে পড়ে শরীফ হোসেনের নিয়ন্ত্রণও। কিন্তু বাদশাহ আবদুল আজিজের দূরদর্শিতায় শরীফ হোসাইন তায়েফ থেকে উঠে আসে।
২০০৭ সালে হজের পর প্রথম তায়েফ গমন করা হয়। ঐ সময় হজযাত্রীরা তায়েফ গমনের জন্য এখনকার মত খোলামেলা সরকারী অনুমতি ছিল না মনে হয়। আমার ধারণা ছিল কারনুল মানাযিল মিকাত তায়েফের পরে হবে। সেই লক্ষে ওমরাহ এর প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। কিন্তু তায়েফ প্রবেশ করতে গিয়ে রাস্তারধারে মিকাত দৃষ্টিগোচর হওয়ায় হতচকিত হই। ফলে সন্ধ্যার পর ফিরবার পথে মিকাতে থেমে এহরামের কাপড় খরিদ করে ওমরাহ এর প্রস্তুতি নিয়ে আসা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালে প্রবাসী শফিউল্লাহ সাহেবের বদান্যতায় সহযাত্রী ডাক্তার মঈনুল হোসেনসহ তায়েফে গমন করা হয়েছিল। ফিরবার পথে সৌদি কর্তৃক নতুন প্রবর্তিত ওয়াদি মাহরাম মিকাত থেকে এহরাম পরিধান করে ওমরাহ এর প্রস্তুতি নিয়ে আসা হয়। এই সফরে শফি উল্লাহ সাহেবের কফিলের বন্ধু শেখ আবদুল আজিজ তায়েফে আমাদেরকে সময় দেয়। ঘুরে দেখান। এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাওয়ান। যা ছিল ঐতিহ্যবাহী ও ব্যয়বহুল খাবার মান্ডী। ঐ সময় আমরা ৫ জনের বিল নিয়ে ছিল মনে হয় ৪ শত রিয়াল বা কম বেশি।
পরবর্তীতে হজ ও ওমরায় সহযাত্রীরা তায়েফ গমন করে থাকলেও আবারও তায়েফ গমন করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। অবশ্যই যে কোন হজ ও ওমরাহকারী তায়েফ গমন করলে ওমরাহ করা অত্যাবশ্যক। যেহেতু তায়েফ মিকাতের বাহিরে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।












