(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অস্টেলিয়ার শানসাইন কোস্টের কোলাম বিচ এবং মাউন্ট কোলামে ঘোরাঘুরি করে বেশ টায়ার্ড লাগছিল। ঠান্ডা আবহাওয়া, কিন্তু মনে হচ্ছিলো ভিতরে ঘেমে গেছি। পাহাড়ে উঠা এবং হাঁটাহাঁটি বেশ কঠিন, বিশেষ করে মোটা মানুষের জন্য। তবুও নতুনকে আলিঙ্গনের যে রোমাঞ্চ তা পেতেই মুলতঃ কষ্ট হলেও ঘুরছিলাম। এদিক ওদিক যাচ্ছিলাম। মন এবং হৃদয় একাকার করে দেখছিলাম নানা কিছু। ভাগিনী তাবাসসুম আমাকে কোত্থেকে যেনো এক বোতল ঠান্ডা পানি এবং নিজের সাথে থাকা ফ্ল্যাস্ক থেকে কফি দিলো, সাথে কিছু বাদাম। পাহাড়ী রাস্তার পাশে পর্যটকদের বসার জন্য তৈরি করা একটি বেঞ্চে বসলাম। এক ঢোকে মিনি বোতলের সব পানি শেষ করে কফিতে চুমুক দিলাম। বাহ, ঘরে তৈরি কফি হলেও স্বাদ–গন্ধ দারুণতো। তাবাসসুমকে কথাটি বলতে সে যেনো খুশী হয়ে গেলো। এমন পরিবেশে কফির মজাটা আসলেই আলাদা হওয়ারই কথা। সামনে উন্মুক্ত সাগর, নীল রঙ থৈ থৈ করছে। মাথার উপর চমৎকার নীলাম্বরী আকাশ। বনের ভিতরে রকমারি পাখীর কলকাকলী। দুর্দান্ত এক আবহ চারদিকে। পাহাড়ের উপর থেকে সাগরে চোখ দিয়ে বসেছিলাম। সাগর যেনো হাতছানি দিচ্ছিলো। কী এক সর্বনাশা সৌন্দর্য! এই রূপে মুগ্ধ হয়ে ঝাঁপ দিলে পৃথিবীর আর কোন সৌন্দর্য দেখার সুযোগ জুটবে না!
আমি উদাস হয়ে সাগরের রূপ দেখছিলাম। ভাগিনীজামাই সাজ্জাদ বললো, আংকেল, চল্লিশ কি.মি দূরে একটি ন্যাশনাল পার্ক আছে। সানশাইন কোস্টের সবচেয়ে সুন্দর বিচও ওখানে। যাবেন নাকি!
আমাকে আর ঠেকায় কে! মুহুর্তেই চাঙ্গা হয়ে গেলাম। তাবাসসুম বললো, যাবেন মানে, অবশ্যই যাবো। নোসা না দেখে আংকেলকে শানসাইন কোস্ট থেকে যেতে দেবো নাকি! আমরা ফিরতি পথে হেঁটে গাড়িতে উঠলাম। আগের মতো ফ্রন্ট সিটে আমি, পেছনে ইভানকে চাইল্ড সিটে বসিয়ে পাশে তাবাসসুম। স্টিয়ারিংয়ে সাজ্জাদ। চমৎকার একটি রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করলো গাড়ি, আমাদের গন্তব্য নোসা ন্যাশনাল পার্ক। রাস্তাটির বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই। কী যে সুন্দর। পাহাড় এবং সাগর যেনো রাস্তাটিকে আগলে রেখেছে। পুরো রাস্তায় সারি সারি গাছের ছায়া।
অস্ট্রেলিয়ায় হাত বাড়ালেই সাগর, পা বাড়ালে বন–বনানী। প্রকৃতি উজাড় করে নানা কিছু ঢেলে দিয়েছে দেশটিকে। এক বছর ঘুরলেও দেশটির সবকিছু দেখা সম্ভব নয়। তবুও যতটুক দেখা যায় তা দেখার চেষ্টা করছি।
আমাদের গাড়ি ছুটছে। সানশাইন কোস্টের ইউক্যালিপটাসের সারির দিকে তাকিয়ে বিভোর হয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম। নোসা হেডসে পৌঁছে গেলাম আমরা। হেস্টিংস স্ট্রিটের পাশেই খেলা করছিলো সমুদ্র। রাস্তার শেষটাই নোসা মেইন বিচ। তকতকে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন একটি বিচ। বিচের বালি যেনো কিছুটা অন্যরকম। চকচক করছে, টানছে। কলকল করছে সাগর। বিচের ডানদিকে তাকালেই সবুজ পাহাড়, ওটাই নাকি নোসা ন্যাশনাল পার্কের হেডল্যান্ড অংশ।
দূরন্ত যৌবনের মতো কলকলিয়ে উঠছিল আমার মন। যেনো ফিরে গিয়েছি শৈশবে। হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের পাশের বোর্ডওয়াক ধরে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা পেয়ে গেলাম পার্কের প্রবেশদ্বার। আমরা গেট পার হলাম, পাকা এবং সমতল রাস্তা ধরে এগুলাম সামনে। চারদিকে বন ক্রমে গভীর হয়ে উঠছিল। একেবারে ঘন বন, আশেপাশে শতবর্ষী সব গাছ, মাথার উপরে গাছের ছায়া। আমরা নিজেদেরকে একসময় এক বুনোজগতে যেনো আবিষ্কার করলাম।
কিছুদূর এগুতেই একটি ভিউপয়েন্ট পাওয়া গেলো। এটির নাম নাকি ‘বয়েলিং পট’। নামের সার্থকতা টের পেলাম অল্পক্ষনের মধ্যে। নিচে সাগরের ঢেউগুলো তেড়ে তেড়ে এসে এমনভাবে পাথরের ফাঁকে আছড়ে পডে ফেনা তৈরি করছিল যে, মনে হচ্ছিলো পানি ফুটছে। যেন সাগর একটি ফুটন্ত কড়াই! ঘন জঙ্গল, সামনে উন্মুক্ত সাগর, নিচে পাথরের উপর সাগরের কোলাকুলি। প্রকৃতি অপরূপ হয়ে উঠতে এর থেকে বেশি কিছুর দরকার আছে কি!
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখলাম। মনের পর্দায় আজীবন স্মৃতি করে রাখার মতো করে গেঁথে নিলাম। তাবাসসুম বললো, আংকেল, সামনে চলেন। আরো সুন্দর। কিছুদূর এগুনোর পর আবারো একটি ভিউ পয়েন্ট পাওয়া গেলো। এটির নাম নাকি ডলফিন পয়েন্ট। নামেই বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে ডলফিন নৃত্য করে। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, কয়েকটি ডলফিনের দর্শনও মিলে গেলো। বুনো ডলফিন। পোষ মানানো ডলফিনের নাচ দেখেছিলাম থাইল্যান্ড এবং সিংগাপুরে। আর এখানে সাগরের ডলফিন যেনো দর্শনার্থীদের মনে নাচন ধরাতে ঝোঁপঝাপ ভেল্কি মারে। এখানে নাকি মাঝে মধ্যে বড় আকৃতির তিমিও দেখা যায়। সাজ্জাদ বলছিলো, হাম্পব্যাক হোয়েলের দেখা মাঝে মধ্যে মিলে। তবে আমার আগমনে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না, দর্শন দিলো না।
বনের ভিতর দিয়ে হাঁটছিলাম। হাঁটার চমৎকার পথ করে রাখা হয়েছে। ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে এমন সুন্দর পথ, ভাবা যায়! জঙ্গলে সাপের উপদ্রুপ আছে কিনা জানতে চাইলাম। সাজ্জাদ বললো, কোনদিন কোন অঘটন ঘটেছে বলে তারা শুনেনি।
বনের পথ একেবারে নির্জন, গা ছমছম করছিলো। চারপাশে ইউক্যালিপটাস আর পাণ্ডানাস গাছের ঘন পাতার ছায়া। আরো কিছু পথ যাওয়ার পর ‘টি ট্রি বে’ নামের একটি অংশ পেয়ে গেলাম। বনের এসব অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বণ্যপ্রাণীর দেখা মিলে। আমরাও কিছু কিছু প্রাণীর দর্শন পেলাম। গাছের ঢালে আয়েশ করে কোন কোন প্রাণী ঘুমুচ্ছিলো। তবে এই ধরনের কোন প্রাণী আগে কোনদিন দেখেছি বলে মনে করতে পারছিলাম না। নিচে ছোট পাথুরে বিচ, টলটলে নীল পানি। এই জায়গাটি নাকি এই পার্কের সবচেয়ে শান্ত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটি জায়গা।
নোসা ন্যাশনাল পার্কে ঘুরলাম, বিচে পা মাড়ালাম। সাগরের নোনতা হাওয়ায় গা ভাসালাম। কোনদিন দিয়ে যে মাথার উপরে সূর্য চলে এসে টের পাচ্ছিলাম না। দুপুর হয়ে গেছে। বহুপথ যেতে হবে। কিন্তু নোসা ন্যাশনাল পার্কের রূপ অসম্পূর্ণ দেখে ফিরতি পথ ধরতে ইচ্ছে করছিলো না। সাজ্জাদ ও তাবাসসুমও কিছু বলছে না। আমার মনে হলো তারা আমাকে আজকেও আটকে রাখতে চাচ্ছে। তবে আমি আর শানসাইন কোস্টে থাকতে চাচ্ছিলাম না। অনেকদিন একসাথে থাকতে থাকতে লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং বিজয় শেখর দা’র জন্য মন খারাপ লাগছিলো।
আমি সাজ্জাদকে বললাম, বাবা, সবই তো মনে হয় একই রকম। একই বিচ, একই সাগর, একই বন, জঙ্গল। চলো, গোল্ড কোস্টে দিকে যাত্রা করি। নাহয় আমাকে রেখে আবার তোমাদের ফিরে আসতে ভোর হয়ে যাবে।
সাজ্জাদ ও তাবাসসুম বললো, বেশি দেরি হবে না আংকেল। আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। আমি আরো একটু ঘুরে দেখেন। এমন সুন্দর জায়গা দুনিয়ায় খুব বেশি নেই।
আমি হাসলাম। বললাম, পুরো অস্ট্রেলিয়াই তো যেনো স্বর্গোদ্যান। কোনটি রেখে কোনটি দেখবো। এক ঝলক করে যতটুকু দেখা যায় দেখে নিচ্ছি আর কি!
শুনলাম যে, নোসা ন্যাশনাল পার্কের ট্র্যাকটি ১০.৮ দীর্ঘ। হেঁটে এই পথ পার হতে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগে। ট্র্র্যাকের বেশ কিছু অংশ বেশ উঁচু–নিচু। তাই বেশ শক্তি ও সময় লাগে। আমি সে চেষ্টা না করে গাড়ির কাছে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। মনে হচ্ছিলো, নোসা ন্যাশনাল পার্ক এমন একটি জায়গা যেখানে একই সাথে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, বন্যপ্রাণী–সবকিছু দেখা হয়ে যায়। আর এজন্যই এটি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত সমুদ্রতীরবর্তী ন্যাশনাল পার্কগুলোর একটি। অবশ্য, অস্ট্রেলিয়াতে ন্যাশনাল পার্কের অভাব নেই। পুরো দেশটিই যেনো একটি পার্ক।
ফিরতি পথ ধরেছি আমরা। মনে হলো মেঘলা আকাশ এবং শীতল আবহাওয়ায় প্রকৃতি ঠিকঠাকভাবে কলকল না করলেও পাহাড় এবং সাগরের জড়াজড়িতে সারাক্ষণ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। এক একটি ঢেউ তেড়ে তেড়ে এসে লুটিয়ে পড়ছিলো পাহাড়ের গায়ে, যেনো ভরিয়ে দিচ্ছিলো আদরে সোহাগে। নানা রূপে পাহাড়, বনানী এবং সমুদ্রের মাখামাখি বিচগুলোতে বিমোহিত করছিলো হাজারো পর্যটককে।
আমার অন্তর হু হু করছিলো। মনে হচ্ছিলো, আহারে সাগর, আহারে পাহাড়, আহারে প্রকৃতি! কী অপরূপ সাজেই না চারদিক সেজে আছে!! অথচ আমাদেরও সাগর আছে, পাহাড় আছে, সমুদ্রও আছে, তবে—। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।












