আত্মশুদ্ধির জন্য শুধু শিক্ষা নয়, যথার্থ শিক্ষার প্রয়োজন

শিউলী নাথ | মঙ্গলবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ১১:১৭ পূর্বাহ্ণ

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনে শিক্ষা কথাটি জড়িয়ে রয়েছে মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক সকল প্রকার অগ্রগতির পেছনে যে উপকরণ কাজে লাগে তা হল শিক্ষা। শিক্ষা অতীতের সংস্কৃতিকে বহন করে, বর্তমান সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের প্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। সংকীর্ণ অর্থে বিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান বা কৌশল কে শিক্ষা বলা হয়। কিন্তু কোন মনোবিদ বা কোন বিজ্ঞানী বিদ্যালয়ের অর্জিত জ্ঞানকে প্রকৃত শিক্ষা বলতে চাননি। শিক্ষাবিদরা মনে করেন শিক্ষা এক ধরনের জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া যা মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে এবং আচরণে পরিবর্তন আনে।

তাহলে শিক্ষা মূলত কি? কে কাকে শিক্ষা দিবে? শিক্ষার মূল ভীত কী শুধু শিক্ষকই তৈরি করে দিবেন? বিদ্যালয়ের ওই কয়েক ঘন্টায়, একজন শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে যে জ্ঞান লাভ করে তাই কি প্রকৃত শিক্ষা? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, প্রাগৈতিহাসিক কালে শিক্ষা শুরু হয়েছিল বয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা যুবকদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে। প্রাক শিক্ষিত সমাজ মূলত মৌখিকভাবে ও অনুকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্লেটো এথেন্সে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ছিল ইউরোপের উচ্চতর শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। এটি ৩৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এথেন্সের বুদ্ধিভিত্তিক প্যাড হিসেবে এটি প্রাচীন গ্রিসে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। চীনে কনফুসিয়াস সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন যিনি শিষ্যদের একত্রিত করেন এবং একজন শাসককে নিরর্থকভাবে অনুসন্ধান করেন। যিনি সুশাসনের আদর্শ গ্রহণ করতে পারেন। এইসব হল প্রথাগত শিক্ষার প্রাথমিক দিক। কিন্তু আদিম যুগে মানুষ ছিল অসহায়। প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে তাকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছে। গুহা মানব বন্য পশু মেরেছে পাথর ছুঁড়ে। এই পাথর ছুঁড়ে তার জ্ঞানহয়েছে যে, পাথর দিয়ে পশুকে তাড়ানো যায়। এরপর তার মধ্যে বোধএসেছে পাথরের আঘাতে পশু মরেও যেতে পারে। এইবোধ থেকে এসেছে পশুকে পাথর ছুঁড়ে মারার পরিকল্পনা। অর্থাৎ পাথর প্রয়োগকরে মারার চেষ্টা। পাথর তো ভোঁতা। তাই একে সূঁচালো বা ধারালো করতে পারলেই পশুকে ঘায়েল করতে সুবিধা হবে। তাই পাথর কেটে অস্ত্র তৈরি করতে তার দক্ষতাএসেছে। এভাবেই জ্ঞান, বোধ, প্রয়োগ, দক্ষতার হাত ধরে শিক্ষা এগিয়ে চলছে যুগ যুগ ধরে।

শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের উৎস হিসেবে সংস্কৃত সাহিত্যে বলা হয়েছে, “আচার্যৎ পাদম্‌ আধত্তে পাদম্‌ শিষ্যঃ স্বমেধয়া পাদম্‌ স্ব ব্রহ্মচারিভ্যঃ পাদম্‌ কালক্রমেন চ। অর্থাৎ শিক্ষার্থী জ্ঞানের একটু চতুর্থাংশ লাভ করে শিক্ষকের কাছ থেকে, একটু চতুর্থাংশ লাভ করে নিজস্ব বুদ্ধিতে, এক চতুর্থাংশ লাভ করে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ আলোচনায়। বাকি অংশ তার সমগ্র জীবন কর্মধারায় অর্জিত হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ দেশে আজ নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সব শিশুদের জন্য পূর্ণ সময়ের শিক্ষা স্কুলে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই কারণে বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিস্তার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে মিলিতভাবে ইউনেস্কো গণনা করে লক্ষ্য করেছে যে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে আরো মানুষ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করবে যা মানব ইতিহাসে বিরল ঘটনা হবে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের মহান ব্রত পালন করেন যারা, তারাই হলেন শিক্ষক। শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। কারণ আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও ন্যায়ের শিক্ষা দিতে। আদর্শ শিক্ষকের আদর্শ পাঠ একজন শিক্ষার্থীর মানবতাবোধকে যেমন জাগ্রত করে তেমনি দেশের উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করে। শিক্ষার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটুকু ধারণা পাওয়া যায়,কেউ না কেউ থাকেন যিনি উৎসাহ অনুপ্রেরণায় সামনে এগিয়ে নেন। বর্তমানে সেই ভূমিকা শিক্ষকের। শিক্ষক পথপ্রদর্শক আর শিক্ষার্থী পথিক। শিক্ষকের দেখানো পথেই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের আলো দেখতে পায়। শিক্ষকশিক্ষার্থীর সম্পর্ক সকল হীন স্বার্থ ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক অন্য কিছু প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষক শুধু আশা করেন সদাচরণ ও সৎ স্বভাব। শিক্ষার্থীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে শিক্ষক আনন্দিত হন। বিপথগামী হতে দেখে ব্যথিত হন। শিক্ষা সম্পর্কিত যে সংজ্ঞাগুলো বিভিন্ন মনীষী দিয়েছেন, বস্তুত সেসময়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীশিক্ষক সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের দেবতার মত শ্রদ্ধা করতেন। শিক্ষকের এক একটি আদেশ উপদেশ ছিল তাদের কাছে মহামূল্যবান। শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক আমরা পাই মহাভারতের পঞ্চপান্ডব ও দ্রোনাচার্যের মধ্যে। বাদশা আলমগীরের কথা ও আমরা জানি। আরো জানি, ছাত্র আলেকজান্ডারের মৃত্যুতে গুরু অ্যারিস্টটল কেমন দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন।

শিক্ষক শিক্ষার্থীর মহান সম্পর্ক আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তার প্রধান কারণ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে নিজ হাতে পা ধুয়ে দিয়েছেন। অথচ আজ সেই হাতে তারা শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে। তবে যেটি মূল কথা আজ শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যে নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নেই। যাকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হচ্ছে তিনি তার নীতি ভুলে ছাত্রদের ডিগ্রি লাভের শর্টকাট উপায় বলে দিচ্ছেন, ছাত্রদের ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে ছাত্ররা বিনাশ্রমে সর্বোচ্চ ফলাফলে শিক্ষকের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। অসদুপায়ে ভালো ফলাফল লাভে শিক্ষককে ব্যবহার করছে। তবে এই কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে অভিভাবকেরা সচেতন নন। অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানের কল্যাণে হেন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। শিক্ষক শিক্ষার্থী কোন ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়। এই সম্পর্ক পথপথিকের, গুরুশিষ্যের। আমাদের সেই বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।

শিক্ষা সেই আদিম কাল থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু তার ধরন আজ বদলেছে। কেননা আমরা সভ্য হয়েছি। সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের আচরণিক পরিবর্তনকে সুসংহত করে এগিয়ে নিতে হবে। শিক্ষা গ্রহণ করে তাকে যদি কার্যে প্রয়োগ না করা যায়, তবে সেই শিক্ষা বিফল। সঠিক শিক্ষার পথ দেখাতে হবে, সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক সবাইকে সচেতন হতে হবে। তবে ‘শিক্ষা’ নামক শব্দ যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করবে। বস্তুত আত্মশুদ্ধির জন্য শুধু শিক্ষা নয়, যথার্থ শিক্ষার প্রয়োজন।

লেখক: কবি ও গল্পকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে কিন্ডারগার্টেনের তুলনা নয়
পরবর্তী নিবন্ধএক মহাজীবন : ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির