একটি নাট্যদল অর্ধশতাব্দী ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকাটা আজকের এই ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ সাংস্কৃতিক জগতে নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। চট্টগ্রামের প্রাচীন নাট্যদল গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় সে অভীষ্ঠ অর্জন করতে পেরেছে এবং তা সফলতার সঙ্গে, এজন্যে প্রথমেই তাদের অভিবাদন এবং আন্তরিক শুভ কামনা। গণায়ন তাদের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য একটি নাট্য উৎসবের আয়োজন করে ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর। সাত দিনব্যাপী এই নাট্য উৎসবে উল্লেখযোগ্য ছয়টি নাটকের মঞ্চায়নের পাশাপাশি মুক্তমঞ্চে প্রতিদিন আয়োজন করা হয় মানসম্পন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন বিপুল দর্শক সমাগমের মধ্য দিয়ে উৎসবটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাজারী গলির দশমহাবিদ্যা মন্দিরের ছাদে। প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন আচার্য, প্রদীপ খাস্তগীর, মিলন চৌধুরী, ডা.মনোতোষ ধর, দেবব্রত দেয়ানজী, শিবনাথ দত্ত, অভীক ওসমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, কালাম চৌধুরী। ১৯৭৬ সালে গণায়নের কার্যক্রমে সংযুক্ত হন; ম. সাইফুল আলম চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সুলতানুল ইসলাম, শওকত হোসেন, মশিউর রহমান আদনান। ১৯৭৬ সালের ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জের সিএন্ডবি মিলনায়তনে গণায়ন প্রথমবারের মতো নাটক মঞ্চায়ন করে। প্রথম মঞ্চায়নে ছিল দুটি নাটক; মিলন চৌধুরী রচতি ‘চর্যাপদের হরিণী’ ও চিররঞ্জন দাশ রচিত ‘গফুর আমিনা সংবাদ’ । ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গণায়ন চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মোড়ে প্রদর্শন করে বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’। এটি বাংলাদেশের নাট্যজগতে পথিকৃৎ ও কিংবদন্তী পর্যায়ের একটি অধ্যায়।
১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যস্ত পরিপার্শ্বিকতায় গণায়ন তার তরুণ নাট্যসৈনিকদের সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের উদ্দীপনা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। গণায়নের অন্যতম সেনানী, যিনি ১৯৭৬ সাল থেকে দলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত এবং ১৯৮০ সাল থেকে অদ্যাবধি দল প্রধানের দুরুহ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সফলতা ও দক্ষতার সঙ্গে। তিনি অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী, তাঁর কথায়, “অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল তরুণ ১৯৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মিলিত হন শিল্পিত সামিয়ানার নিচে, গড়ে তোলেন গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়-‘নাটকের শিল্পিত চেতনায় জীবনসত্য প্রকাশে প্রত্যায়ী আমরা’ এই অঙ্গীকার নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল জীবনের নিরন্তর সংগ্রাম–মুখীনতা, সততা ও বিশ্বস্ততাকে শিল্পের শুদ্ধতার উচ্চারণে রূপান্তর। সেই ১৯৭৫–৭৬ এর পর এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রজন্মের আগমন ঘটেছে স্বভাবতই। কিন্তু শুরুর সে অঙ্গীকার এখনও অক্ষুন্ন রেখেছেন সকলেই। ৫০ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমায় ৩৬ টি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে যা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্মরণীয় প্রযোজনা রয়েছেঃ সাজানো বাগান, গন্ধরাজ, ঘোড়া এলো শহরে, শেষ সংলাপ, কমরেডস হাত নামান, এই ঘর এই বসতি, অদ্ভুত অন্ধকার, তিনি আসছেন, জুলিয়াস সিজারসহ আরও কয়েকটি। নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে এদেশের নাট্যকারদের পাশাপাশি বিদেশি নাট্যকারদেরও সমান গুরুত্ব দিয়ে এসেছে গণায়ন। এক্ষেত্রে অনুবাদ এবং রূপান্তরের ওপর জোর দিয়েছে দলটি এবং সফলতাও দেখিয়েছে। সব মিলে একটা মানসম্পন্ন পরিমন্ডল গড়ে তুলতে সচেষ্ট থেকেছে গণায়ন যা আন্তর্জাতিক বোধ তৈরিতে সহায়তা করেছে।
সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত গণায়ন নাট্য উৎসব ২০২৫–এ ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর যথাক্রমে মঞ্চস্থ হয় জুলিয়াস সিজার, আমার আমি, কমলা সুন্দরীর কিসসা, তিনি আসছেন, বৃত্তের বাইরে এবং বাল্মিকী প্রতিভা। গণায়ন ছাড়া অন্য তিনটি নাট্যদল নান্দীমুখ, কথা সুন্দর ও ফেইম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের পরিবেশিত নাটক উৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছে। ১৪ অক্টোবর উৎসবের পঞ্চম সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় ইউজিন আয়েনেস্কোর মূল নাটকের অবলম্বনে ম. সাইফুল আলমের ভাবানুবাদে মামুনুল হকের নির্দেশনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রযোজনা-‘তিনি আসছেন।’
রোমানিয়ান–ফরাসি নাট্যকার ইউজিন আয়োনেস্কো রচিত ‘দি লিডার’ নাটকের ভাবানুবাদ করেছেন অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী। নির্দেশনায় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুল হক। অভিনয় করেছেন এই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং নেপথ্যে কাজ করেছেন বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা। সে দিক থেকে নাটকটিকে একাডেমিক এবং প্রয়োগিক প্রযোজনাও বলা যায়। যেহেতু নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী এবং নেপথ্যকুশলীদের সকলেই তরুণ ও নবীন প্রজন্মের, সে কারণে একটি স্বতস্ফূর্ত পরিবেশনা লক্ষণীয়। একাডেমিক প্রয়োগের সুবিধায় স্বাধীন গবেষণাধর্মিতার বিষয়টিও লক্ষ করা গেছে। যেমন, নাটকটির নির্মাণ ভাবনায় নাট্যকার সেলিম আলদীন রচিত ‘সংবাদ কার্টুন’ নাটকের দুটি দৃশ্যের অনুপ্রেরণায় দু’টি দৃশ্য রচনা করেছেন নির্দেশক যা আরোপিত মনে হয়নি।
অনুবাদক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী ভিনদেশি নাটকটিকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এমনভাবে রূপান্তরিত ও প্রতিস্থাপিত করেছেন যে, মনেই হয়নি এটা বিদেশি কোনো নাটকের ভাবনুবাদ। অবশ্য নাটকের প্রেক্ষাপট তৃতীয় বিশ্বের নিষ্পেশিত সব দেশ ও সমাজের জন্য প্রযোজ্য। এ নাটক চলমান বিপর্যস্ত বিশ্বের বিশৃঙ্খল চিত্রকেই উপস্থাপন করে।
‘তিনি আসছেন’ নাটকের প্রচার পুস্তিকায় যথার্থই বলা হয়েছে. ‘বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের মানুষ চিরকাল বিদেশি শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে দাসত্ব করার একটা প্রবণতা এখনও রয়ে গেছে। আর বর্তমান বাজার অর্থনীতির যুগে সরাসরি আগ্রাসন না চালিয়ে; ভূমি, সম্পদ দেশ দখল না করেই সেই প্রভুত্ব জারি রাখা যায় কেবল বাজার দখলে নিয়ে। আর যে দেশে এই কৃর্তত্ববাদিতা বজায় থাকে সে দেশের জনগণের অনগ্রসরতা, পশ্চাৎপদ মনোবৃত্তি, রাজনীতি অসচেতনতা জেঁকে বসে–বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিষয়গুলি ষোল আনাই প্রযোজ্য।
মামুনুল হকের নির্দেশনা যথেষ্ট সুসংহত। প্রায় ৫০ টি চরিত্রকে আয়ত্ত্বে রেখে অভিনয় আদায় করাটা রীতিমতো দুরূহ কাজ, যা তিনি পেরেছেন। তবে কোরিয়োগ্রাফিকাল এপ্রোচ আরও কমালে ভালো হতো। এর পরিবর্তে ন্যারেটিভিটির ওপর জোর দেয়া উত্তম। নাটকটিকে এর যথেষ্ট অবকাশ বিদ্যমান। সংগীতেও পরিমিত বোধের প্রয়োজন রয়েছে। কিছু কিছু দৃশ্যে উচ্চকিত সংগীতের প্রয়োগ বেশ শ্রুতিকটু। অনেক সময় সংলাপ ঢাকা পড়ে গেছে। অরুন্ধতি চন্দ ও প্রিয়া দেভের করা প্রপ্স বেশ যুথসই। আদনান সামী মঞ্চ ব্যবস্থাপনা, আলোক পরিকল্পনা ও প্রক্ষেপনে বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
অভিনাংশ অনেক প্রাণবন্ত। সবার স্বত:স্ফূত অভিনয়ের সমন্বয়ে সুন্দর একটি টিমওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। অভিনয়ে ছিলেন নাট্যকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা, যাদের সংখ্যা বাইশ জন। এদের অনেকেই একাধিক চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন।
সব মিলে বলা যায়, নাট্যকলা বিভাগের এই পরিবেশনা ছিল যথেষ্ট আন্তরিক, উৎসাহব্যঞ্জক এবং একই সঙ্গে প্রয়োগিক প্রশিক্ষণমূলক। ‘তিনি আসছেন’ নাটকের পুরো দলকে অভিবাদন ও অভিনন্দন, বিশেষ করে অনুবাদক ও নির্দেশককে।











