কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ মোকাবিলায় টেকসই ও বাস্তবভিত্তিক রোডম্যাপ বের করতে আয়োজিত এক সম্মেলনে বক্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক ভাবে। এজন্য সরকারের জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগের উপর গুরুত্বারোপ করে তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।
কনফারেন্সে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন বৈশ্বিক সমস্যা। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভারে ভারাক্রান্ত এলাকার লোকজন। রোহিঙ্গা সংকট কেবল মানবিক নয়; এটি ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক জবাবদিহিতার প্রশ্ন।
তারা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব প্ল্যাটফরমে নিয়ে যেতে হবে। এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সমাধান বের করতে হবে। মিয়ানমারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত ও রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গতকাল কক্সবাজারে আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা ইমার্জেন্ট ফিউচার্স : কালেকটিভ ফোরসাইট অ্যান্ড অ্যাডাপটিভ অ্যাকশন’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন। কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (ট্রিপল আর সি) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।
বক্তারা বলেন, বর্তমান মানবিক সংকটকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া মোকাবিলা করা কঠিন। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে নতুন পথ হবে বলে মন্তব্য করে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে টেকসই দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ওসমান গনি মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। বক্তব্য রাখেন কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট পারভীন এফ চৌধুরী, ব্র্যাকের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর নাফিউল হাসান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কনফারেন্স কো–অর্ডিনেটর এবং মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) ব্যুরো চিফ জুলহাস আলম।
পৃথক পৃথক সেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রহমান নাসির উদ্দিন। এ সেশন সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের সিনিয়র ডিরেক্টর কেএএম মোরশেদ। বক্তব্য রাখেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ, সিবিজিএএর লিড রিসার্চার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, বিএনপি নেতা শাহজাহান চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামী কক্সবাজার জেলা আমির নূর আহমেদ আনোয়ার, এনএসইউ–এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন, সিপিবির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) সাউথ এশিয়া সেলের প্রধান এএসএম সুজা উদ্দিন। দ্বিতীয় সেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাবাব এনাম খান। আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির, ফ্যালসের নির্বাহী পরিচালক আবু মুর্শেদ চৌধুরী, জাতীয় কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ডিরেক্টর আবু সালেহ মো. ইউসুফ।
উন্মুক্ত আলোচনা পর্ব পরিচালনা করেন অতিরিক্ত রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ( যুগ্ম সচিব) আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। সমাপনী বক্তব্য দেন ব্র্যাকের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর ও ওআইসি হিউম্যানিটেরিয়ান ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের প্রধান রেজাউল করিম। সেমিনারে বক্তারা বলেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর পাঁচ বছরে সংকটের মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার ঘাটতি, জীবিকা সীমাবদ্ধতা, ক্যাম্পে জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, নিরাপত্তাজনিত অস্থিতিশীলতা, পরিবেশগত ক্ষতি এবং প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন নিয়ে নীতিগত অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। একই সঙ্গে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপে বিপর্যস্ত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জরুরি মানবিক প্রতিক্রিয়ার বাইরে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই ও প্রমাণভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।







