জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে বিনয়ী মানুষের দেশ হিসেবে পরিচিত। জাপানি সংস্কৃতির একটি মূল ধারণা হলো দয়ালু হওয়া। এই বিনয়, এই দয়া কিভাবে গড়ে উঠলো?
হিরোশিমার ওনোমিসি ভিত্তিক জাপানের অভ্যন্তরীণ পর্যটন সংস্থা ‘ডিসকোভারলিঙ্ক সেটোওসি’র প্রধান নোরিকো কোবাইয়াশির কথাগুলো একটু পড়ি। তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই একটি প্রবাদে অভ্যস্ত হয়ে বড় হয়েছি। প্রবাদটি হচ্ছে, কেউ আমাদের জন্য ভালো কিছু কাজ করেছে। আমাদের অন্য ব্যক্তির জন্য সুন্দর কিছু করতে হবে। কিন্তু পরে কেউ কিছু খারাপ কাজ করলেও আমাদের অন্য কোনো ব্যক্তির জন্য খারাপ কিছু করা উচিত নয়। আমার মনে হয়, এ বিশ্বাস আমাদের আচরণকে ভদ্র করেছে।” দয়া–মায়ার বীজ রোপণে এরচেয়ে আর কি লাগে!
তবে জাপানীদের সাংস্কৃতিক একটা দিকও আছে। জাপানের এই ‘ওমোতেনাশি’ বা নিঃস্বার্থ আতিথেয়তার সংস্কৃতির সাথে অনেকের জানাশোনা আছে। ‘ওমোতেনাশি’ নামে পরিচিত নম্রতার এ আচরণকে বলা যায়– সম্প্রীতি বজায় রাখা ও সংঘাতের পথ পরিহারের আকাঙ্খার সঙ্গে সুক্ষ্ণ ভদ্রতার সম্মিলন। ভদ্র–সভ্য জাপানিদের চমৎকার আচরণের উপায় ও প্রাণশক্তির উৎস ‘ওমোতেনাশি’ জাপানি সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ। যা জাপানকে বিশ্বের সবচেয়ে ভদ্র দেশ বলে পরিচিত করেছে। ‘ওমোতেনাশি’ জাপানের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরকে প্রভাবিত করে, যে ভদ্রতায় শৈশব থেকেই অভ্যস্ত হন জাপানিরা। এই যেমন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কয়েকজন পর্যটক সাইকেল চালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন জাপানের নিনোশিমা দ্বীপে। সময়ের কথা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন। ডুবতে থাকা সূর্য তাদের জানিয়ে দিল তারা একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছেন। শহরের দিকে দিনের শেষ ফেরি ছাড়ার সময় চলে এসেছে। দ্রুত পৌঁছানো দরকার বন্দরে। কী করবেন ভেবে না পেয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকানে জিজ্ঞেস করলেন।
একজন স্থানীয় ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। “আপনারা যদি এ পথে যান তবে এখনো ফেরি ধরতে পারবেন”, একটি পাহাড়ী রাস্তা দেখিয়ে বললেন তিনি। পর্যটকরা দ্রুত সেদিকে সাইকেলের মুখ ঘোরালেন। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তারা অবাক হয়ে দেখলেন, ঐ ব্যক্তিও তাদের পেছনে দৌড়ে আসছে। তারা যাতে পথ হারিয়ে না ফেলেন তা নিশ্চিত করতে। নতুন পাওয়া বন্ধুর সাহায্যে শেষ মুহূর্তে তারা ফেরি ধরতে পেরেছিলেন!
মিডিয়ার প্রতিবেদন মতে, জাপানের প্রতিবেশ আসলে এমনই। কেউ যদি কোনও পথচারীর কাছে দিকনির্দেশনা চান, তাহলে তারা সর্বদা সাহায্য করবে এবং আপনাকে একটি মানচিত্র এঁকে দিতে পারে। কখনও কখনও, তারা নিজেরাই সেখানে নিয়ে যেতে পারে। রাস্তায় নির্মাণ–কাজ চলার সংকেতে একজন কর্মীর বাউ করার চিত্র দুঃখ প্রকাশ করে সাময়িক অসুবিধার জন্যে। এখানকার মানুষ কাশি দেওয়ার পর অন্যদের সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক পরেন। নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই বাতাসে উড়বে– এমন ধুলো থেকে জামা–কাপড় পরিষ্কারে সহায়তা করতে প্রতিবেশীদের ওয়াশিং পাউডারের বাক্স উপহার দেন। দোকান ও রেস্তোরাঁর কর্মীরা অতিথিদের নত হয়ে শুভেচ্ছা জানান। তারা যখন খুচরো ফেরত দেন, তখন এক হাত ক্রেতাদের হাতের নিচে রাখেন, যেন মুদ্রা নিচে পড়ে না যায়!
জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থার এক অনন্য দিক হলো শিশুদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা, যা শুরু হয় জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক স্তর থেকেই। জাপানে শ্রদ্ধা কেবল সামাজিক শিষ্টাচার নয়, বরং শিক্ষার একটি অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ, যা শিক্ষার্থীদের আচরণে প্রাত্যহিকভাবে প্রতিফলিত হয়। শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহপাঠীদের প্রতি সৌজন্য প্রকাশ এসব শুধু পাঠ্যসূচির অংশ নয়, বরং জীবনের অপরিহার্য অনুশীলন হিসেবে আত্মস্থ করা হয়। জাপানি স্কুলে শিশুরা নিজেরাই শ্রেণীকক্ষ পরিষ্কার করে, টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখে, ঝাড়ু দেয়, এমনকি খাবার পরিবেশনেও অংশ নেয়। এখানেই গড়ে ওঠে আত্মনির্ভরতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শক্ত ভিত। জাপানি শিশুদের একত্রে বসে খাওয়া, নিজের খাবার নিজে নেয়া ও অন্যকে খাবার পরিবেশন করা, এবং অংশীদারত্বের মাধ্যমে বন্ধন গড়ে তোলা এসবই শেখায় বিনয়, সমতা ও সামাজিক সংহতি। এ প্রক্রিয়ায় শিশুরা শিখে যে, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা মানবিক সমাজের ভিত্তি।
জাপানের পাঠ্যসূচিতে শিশুদের বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য হলো একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। তারা শেখে, সামাজিক দায়–দায়িত্ব ও মর্যাদা, চাকরি বা সম্পদের চেয়ে মূল্যবান হলো চরিত্র, আত্মসম্মানবোধ ও নৈতিক দৃঢ়তা। শিশুদের জীবনের শুরুতেই শেখানো হয় ব্যক্তিগত পরিসরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে। এটি শুধু ভদ্রতা বা সামাজিক শিষ্টাচারের অংশ নয়, বরং নৈতিকতার একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা বুঝে নেয়, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি নিজস্ব পরিসর বা পরিমন্ডল আছে, যেটিকে সম্মান জানানো মানে তার মর্যাদাকে স্বীকার করা। তাদেরকে শেখানো হয় কাউকে তার পারিবারিক, আর্থিক, শারীরিক অবস্থা কিংবা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা অনুচিত। কারো ওজন, বয়স কিংবা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কৌতূহল প্রদর্শন করা সেখানে শুধু অশোভন নয়, এটি সামাজিক সচেতনতার ঘাটতির লক্ষণ হিসেবেও বিবেচিত হয়। এমনকি জাপানি প্রযুক্তিগুলোও ওমোতেনাশির অনুশীলন করে। আপনি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ট্যাক্সির দরজা খুলে যাবে। লিফট ক্ষমা চাইবে আপনাকে অপেক্ষায় রাখার জন্যে!
আমরা আগামী প্রজন্মকে সত্যিকার অর্থে মানবিক, নৈতিক ও গণতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে জাপানের এ মডেল থেকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। মানবিক ও নৈতিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া, পরিবার ও সমাজকে তার বাস্তব প্রয়োগে অংশীদার করা এবং ব্যক্তির অধিকার ও সামাজিক দায়িত্বের ভারসাম্য রক্ষার ওপর জোর দেয়া দরকার।
বলা হয়, সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই শিষ্টাচার দিয়ে। একটু হাসি, একটি ‘ধন্যবাদ’, কিংবা অল্প সহানুভূতি–এসবই মানুষে মানুষে তৈরি করে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সম্প্রীতির বন্ধন। শিষ্টাচার অনুসরণের মাধ্যমে গড়ে উঠবে এমন এক ভবিষ্যৎ, যেখানে মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়–পাশের মানুষের জন্যও ভাববে, ভালোবাসবে, সহানুভূতিশীল হবে।
শিষ্টাচার কেবল কিছু নির্দিষ্ট আচরণবিধি বা সামাজিক নিয়মের তালিকা নয়–এটি মানুষের ভিতরকার সুকুমারবৃত্তির প্রকাশ। ছোট ছোট অভ্যাস ও আচরণের মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে একজন মানুষের প্রকৃত চরিত্র, তার মূল্যবোধ, তার মানবিকতা। সন্তানকে নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শেখানোর অর্থ তাকে শুধু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলা নয়–বরং তাকে গড়ে তোলা একজন সংবেদনশীল, দায়িত্ববোধসম্পন্ন, বিবেকবান মানুষ হিসেবে।
মানুষের ব্যক্তিত্ব, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং নৈতিক উৎকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হলো আদব বা শিষ্টাচার। এটি কেবল সামাজিক সৌজন্য নয়, বরং মানুষের আত্মিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষের অন্যতম প্রতিফলন। একজন মানুষের কথাবার্তা, আচরণ ও সামাজিক মেলামেশার ধরনে তার ভদ্রতা ও শালীনতা প্রতিফলিত হয়। বলা হয়ে থাকে– “Charity begins at home” । এই মহৎ কাজ নিজ নিজ ঘর থেকে শুরু হোক।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)











