চব্বিশের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার গণ অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এ আজ সোমবার রায় ঘোষণা করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের জানান, আগামীকাল (আজ) ট্রাইব্যুনাল–১ বেলা ১১টায় বসবে বলে রেজিস্ট্রার অফিস জানিয়েছে। এ রায় ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। শেখ হাসিনার সঙ্গে এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন।
রায়ের বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম সাংবাদিকদের বলেন, আগামীকাল (আজ) এই মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে। আমরা আসামিদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি এবং সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছি। রায়টি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সেই সঙ্গে বিটিভি থেকে দেশের অন্য টেলিভিশন তা সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে। এছাড়া বিটিভি থেকে রায়টি রয়টার্স সরাসরি সম্প্রচার করবে বলেও জানা গেছে। অন্যদিকে ঢাকায় বড় পর্দায় কয়েকটি স্থানে সরাসরি রায় ঘোষণা করা হবে। খবর বাসস ও বিডিনিউজের।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এই রায় ঘোষণা করবে। ট্রাইব্যুনালে অপর দুই সদস্য বিচারক হলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আলোচিত এই মামলায় পাঁচটি অভিযোগ এনে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। অন্যদিকে আসামিদের নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়েছেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। এছাড়া রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের খালাস চেয়েছেন তার আইনজীবী।
এই মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম শুনানি করেন। এছাড়া শুনানিতে প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্য প্রসিকিউটরা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণ অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাবাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। মোট ৫৪ জন সাক্ষী এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল–মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১। এক পর্যায়ে দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রুভার) রাজসাক্ষী হন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থান দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, তাদের দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। এখন দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেসব অভিযোগের বিচার চলছে।
শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান। আসাদুজ্জামান খান কামালও ভারতে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলে।
রায় ঘিরে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা জোরদার : শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘিরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে হাই কোর্ট মাজার গেট সংলগ্ন ট্রাইব্যুনালের ফটকে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। আইনজীবী, সাংবাদিক ও ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রবেশ করতে হয়েছে পরিচয়পত্র দেখিয়ে।
বিজিবির নায়েক সুবেদার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, তাদের ২০ সদস্যের একটি দল দায়িত্ব পালন করছে। রাতেও থাকবে, সোমবারও থাকবে।
সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তারা স্বাভাবিক সময়ে ১১৯ জন দায়িত্ব পালন করেন। এখন রয়েছেন ২২০ জন পুলিশ এবং ১২৩ জন এপিবিএন সদস্য। কালকের জন্য আরো দুই প্লাটুন (৪০ জন) পুলিশ চাওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মূল গেটেও বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে।
ঢাকাসহ ৪ জেলায় বিজিবি মোতায়েন : মামলার রায় সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে আগুন ও হাতবোমা বিস্ফোরণের মতো সহিংস ঘটনার জেরে চার জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল বিজিবি সদর দপ্তর এক বার্তায় ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলায় এই মোতায়েনের খবর দেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিজিবি দায়িত্ব পালন করছে বলে জানানো হয়েছে।
রায় ঘিরে আজ ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার রায় সামনে রেখে কয়েকদিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যানবাহনে আগুন, হাতবোমা বিস্ফোরণ, সড়ক অবরোধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি তৎপরতার মধ্যে চার জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হলো।












