তোতলামো : এটি বোঝা নয়, বোঝার বিষয়

ডা: মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু | রবিবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা কথা বলার সময় থেমে থেমে বা আটকে কথা বলেন। এটি আমরা সাধারণভাবে তোতলামো বলে থাকি। এটি আসলে একটি Speech Fluency Disorder । অনেকেই মনে করেন তোতলামো মানে নার্ভাসনেস বা মানসিক দুর্বলতা, কিন্তু আসলে এটি একটি জটিল সমস্যা যার পেছনে শারীরবৃত্তীয়, মানসিক ও সামাজিক উপাদান জড়িত।

তোতলামো কেন হয়?

শব্দকে শ্রুতিমধুর করতে স্বরযন্ত্রের পাশাপাশি তালু, দাঁত, জিহ্বা ও মুখগহ্বরের সমন্বয় প্রয়োজন। কোন ধ্বনির পর কোন ধ্বনি উচ্চারিত হবে- এই নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। যদি এই প্রক্রিয়ার কোথাও সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা দেয়, তবে ব্যক্তি তোতলামিতে ভুগতে পারেন। তোতলামির নির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও জিনগত কারণ অনেক সময় দায়ী থাকে। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে তোতলামি দেখা দেয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আট বছর বয়সের আগেই প্রকাশ পায়।

তোতলামোর কারণ একক নয়;

এটি একাধিক কারণে হতে পারে-

১) জেনেটিক কারণ: পরিবারে যদি কারো তোতলামোর ইতিহাস থাকে, তবে শিশুর মধ্যেও এর প্রবণতা বাড়তে পারে। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে তোতলামো সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট জিন ভাষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এটি নির্দেশ করে যে তোতলামো এক ধরনের বংশগত নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার হতে পারে।

২) নিউরোলজিক্যাল কারণ: মস্তিষ্কের ভাষা ও বাক নিয়ন্ত্রণে জড়িত এরিয়া, বিশেষ করে Brocas area, motor cortex, Ges supplementary motor area–Gi এবংGes supplementary motor area– এর কার্যগত অসামঞ্জস্যতা বা নিউরাল কানেক্টিভিটির ব্যাঘাত তোতলামোর উৎপত্তি ও স্থায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৩) মনস্তাত্ত্বিক কারণ: যদিও তোতলামো মানসিক সমস্যার ফল নয়, তবে ভয়, উদ্বেগ, আত্মসম্মানহীনতা বা মানসিক চাপ তোতলামোর তীব্রতা বাড়ায়। অনেকে সমাজে ব্যর্থতার ভয়, আত্মসম্মানহীনতা বা অপমানের আশঙ্কা থেকে আরও কম কথা বলেন, ফলে তোতলামোর একটি ভয়চক্র (Fear Cycle ) তৈরি হয়। “ভয় → তোতলামো → আরও ভয়।”

৪) পরিবেশগত কারণ: শিশুর কথাবলার ধরন নিয়ে বারবার মন্তব্য করা, উপহাস, বা তিরস্কার করা তার আত্মবিশ্বাসে আঘাত করে। অতিরিক্ত কঠোর পিতামাতা বা শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া শিশুর মধ্যে বক্তৃতা ভয় (Speech anxiety ) তৈরি করতে পারে। অপরদিকে, সমর্থনময় পরিবেশ তোতলামো কমাতে সাহায্য করে।

তোতলামোর ধরন : তোতলামো সাধারণত তিনটি ধরনের হয়- ১. Repetition (পুনরাবৃত্তি): একই শব্দ বা ধ্বনি বারবার বলা (যেমন- মা মা মা আমি যাব)। ২. Prolongation (প্রসারণ): শব্দ টেনে বলা (যেমন- ম ্ত া আমি যাব)। ৩. Block (আটকে যাওয়া): কথা শুরু করার আগে বা মাঝে শব্দ আটকে যাওয়া।

বাংলাদেশে তোতলামো সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সীমিত। তবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কথাবার্তা ও ভাষাগত সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্বব্যাপী গবেষণা থেকে জানা কিছু তথ্য প্রায় ৫-১০% শিশু জীবনের কোনো পর্যায়ে তোতলায়। পুরুষদের মধ্যে তোতলামো প্রায় চার গুণ বেশি। মস্তিষ্কের ভাষা নিয়ন্ত্রণ অংশে সূক্ষ্ম গঠনগত পার্থক্য তোতলামোর সঙ্গে যুক্ত। এটি শুধুই বাক প্রবাহের সমস্যা নয়; আত্মবিশ্বাস ও মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও গভীর সম্পর্কিত। শিশু অবস্থায় যত দ্রুত থেরাপি শুরু করা যায়, তত ভালো ফল পাওয়া যায়।

তোতলামো শুধু কথা বলার অসুবিধা নয়, এটি আত্মবিশ্বাস, সামাজিক অংশগ্রহণ এবং মানসিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলে। অনেকেই কথা বলার ভয় বা লজ্জার কারণে জনসমক্ষে কথা বলা এড়িয়ে চলেন, ফলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিতে পারে। তোতলানো ব্যক্তিরা কোন কোন ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন-

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে : ক্লাসে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বা প্রেজেন্টেশনে অংশ নিতে সংকোচ বোধ করেন।

চাকরিক্ষেত্রে : ইন্টারভিউ বা অফিসিয়াল মিটিংয়ে কথা বলার সময় নার্ভাসনেস বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সামাজিক অনুষ্ঠানে: বন্ধু বা আত্মীয়দের মাঝে কথা বলার সময় অস্বস্তি অনুভব করেন।

দৈনন্দিন জীবনে : দোকানে কিছু চাওয়া, ফোনে কথা বলা বা নতুন কারো সঙ্গে আলাপ করা কঠিন মনে হয়।

মানসিকভাবে : আত্মবিশ্বাস কমে যায়, উদ্বেগ ও হতাশা বেড়ে যায়।

তোতলামো ব্যবস্থাপনা ও থেরাপি : এই ধরনের রোগীদের জন্য স্পিচ থেরাপি, মানসিক কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনে নিউরোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কার্যকর কিছু পদ্ধতি হলো-

ধীরে ও ছন্দময়ভাবে কথা বলার অভ্যাস করা। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মাংসপেশির টান কমানো। আয়নার সামনে কথা বলার অভ্যাস করা। নতুন করে সাবলীল বাকপ্রবাহ শেখানো। তোতলামোর মুহূর্তগুলো সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখানো। তোতলামো নিয়ে লজ্জা না পেয়ে সামাজিকভাবে কথা বলার অনুশীলন করা। পিতামাতা ও শিক্ষকের সহানুভূতি ও উৎসাহ প্রদান। অন্য তোতলানো ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

তোতলামোকে ত্রুটি নয়, বরং ভাষার বৈচিত্র্য হিসেবে দেখা উচিত। এটি নিয়ে হাসাহাসি নয়, বোঝাপড়া ও সহানুভূতি জরুরি।

লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধনতুন অধ্যায়ে ফারিণ