পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ অপরিহার্য

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | শনিবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক শোভা বর্ধন করে না বরং মাটির ক্ষয় রোধ, বন্যা প্রতিরোধ, ঝড় তুফানকে প্রতিহত করে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে থাকে। পরিবেশে আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণেও বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। বৃক্ষ ও প্রাণীকুল একে অপরের জীবনরক্ষায় ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রাণীকুলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে অক্সিজেনের অত্যধিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রাণীদের বেঁচে থাকার মূল উপকরণ হলো অক্সিজেন যা বৃক্ষ থেকে উৎপন্ন ও নির্গত হয়ে থাকে। আমাদের প্রতিটি নিশ্বাস প্রশ্বাসে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করে থাকি। বৃক্ষই সেই দূষিত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে নেয় এবং প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নিসঃরণ করে। বৃক্ষ থেকে নি:সরিত অক্সিজেন গ্রহণ করেই আমরা বেঁচে থাকি। পরিবেশগতভাবে বৃক্ষ আমাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক বনজ সম্পদ। অনেক বৃক্ষের পাতা, ফল, বীচি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। বৃক্ষ থেকে আহরিত তন্তু আমাদের পরিধেয় বস্ত্র তৈরীতে সহায়ক। বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত কাঠ বাড়িঘরের কাঠামো তৈরী এবং সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরির কাজে কাঠের ব্যবহার অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। বৃক্ষ বন ও পরিবেশের সৌন্দর্য বর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বৃক্ষই জীবজগতকে ছায়া দিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। বৃক্ষহীন অঞ্চল ক্রমান্বয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। বৃক্ষ বনাঞ্চলের জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুকে ঘনীভূত করে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সহায়তা করে। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ ও কৃত্রিম উপায়ে বনাঞ্চল সৃষ্টির কারণে এসব দেশে এখন বৃষ্টিপাতের হার অনেকাংশে বেড়েছে। আবার বৃক্ষের অপর্যাপ্ততায় বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির তারতম্যও লক্ষ্য করা যায়।

বনাঞ্চল তথা প্রকৃতির বুকে মানুষের নিঃস্বার্থ উপকারী বন্ধু হলো বৃক্ষ। বৃক্ষ ছাড়া মানুষসহ প্রাণীকুলের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বনানীর বৃক্ষরাজির গভীরে প্রাণীকুলের বাস। কথায় আছে বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে । কিন্তু বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন ও বৃক্ষ নিধনের ফলে বন্যপ্রাণীরা বনের আবাসস্থল হারিয়ে ভীষণ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ফলে আবসস্থল হারানো বন্যপ্রাণীরা দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভিনদেশের বনাঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এতে বনসম্পদ নিধনের ফলে বন্যপ্রাণীর অবলুপ্তি ঘটে যারফলে দেশ মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এদিকে বৃক্ষের ছায়াতলে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা ও মানববসতি। তাই বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব একেবারেই চিন্তা করা যায়না। এককথায় বৃক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশ দূষণ রোধ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে বৃক্ষ বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।

পরিবেশ শান্ত, শীতল ও মনোমুগ্ধকর করতে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তাই অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন হজরত মুহাম্মদ (সা 🙂। তিনি বলেছেন “যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ কাটবে আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন”। তিনি আরও বলেছেন “যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপণ করে, আর ক্ষেতে ফসল বোনে এবং তা থেকে কোনো পোকামাকড়, মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে”। তাছাড়া ইসলাম ধর্ম বৃক্ষরোপণকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং গুরুত্বসহকারে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু নগরায়ণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ধারায় মানুষ মোহযুক্ত লোভে অপ্রতিরোধ্য গতিতে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে যাচ্ছে যারফলে উজাড় হচ্ছে বন, দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিছু ক্ষেত্রে বাড়ছে উন্নয়ন, তবে মানবসভ্যতা পড়ছে হুমকির মুখে। লোভী বনদস্যুদের লালসার শিকারে পরিণত হয়ে সুন্দর বনভূমিগুলো মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিষক্রিয়ায় মানুষ জটিল রোগের শিকারে পরিণত হচ্ছে। দূষণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে দুরারোগ্য ব্যধিতে ছেয়ে যাবে বৈশ্বিক পরিমন্ডল। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কুমেরুর বরফ গলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে, বৃষ্টিহীনতায় বৃষ্টি কমবে, অতিরিক্ত উষ্ণতায় মাটি হয়ে উঠবে রুক্ষ। আফ্রিকার সুদানসহ বহুদেশ এবং আমেরিকার আমাজান অববাহিকায় বিপর্যয়ের যে অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে তা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দৃশ্যনীয় হবে। তাই যেকোনো দুর্বিষহ অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে এখনই।

পরিবেশ দূষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনতে বৃক্ষের প্রয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৃক্ষ ও বনানীর প্রতি নির্দয় হওয়া মানে নিজের জীবন বিপন্ন করা। বনজ সম্পদের প্রত্যাশিত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃক্ষ ও বন সৃজনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রকৃতি ও প্রাণীকুলের জীবন সুরক্ষায় বৃক্ষরোপণ একটি কার্যকর অভিযান হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া একটি বৃক্ষ যতদিন বাঁচবে তারচেয়ে অধিক পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সমতা রক্ষার জন্য দেশের মোটভূখণ্ডের অন্তত শতকরা ১০ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বিলম্বে হলেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলকে এর অভাবনীয় গুরুত্ব সম্পর্কে আরো সচেতন হতে হবে। সুখের বিষয় হচ্ছে ইদানীং বিভিন্ন সরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীকে এগিয়ে নিতে ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। পরিবেশ উন্নয়নের স্বার্থে বৃক্ষরোপণ করে বনায়ন সৃষ্টি কাজে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন ছাড়া দেশের অন্যান্য সেক্টরে টেকসই উন্নয়ন সুদূর পরাহত। বৃক্ষহীন পরিবেশ জীবন ও জীবিকার অস্তিত্ব রক্ষায় বিরাট বাধাস্বরূপ। সৃষ্টির প্রারম্ভিক স্তরে সৃজিত পরিবেশের ওপর মানুষের নিষ্ঠুর নিয়ন্ত্রণের ফলে বিভিন্ন বিভিন্ন বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে প্রকৃতি নিচ্ছে নির্মম প্রতিশোধ। সুতরাং প্রাকৃতিক পরিবেশে সুন্দর ও সুস্থ জীবন উপভোগ করতে হলে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন সৃজনের কোনো বিকল্প নেই। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যথোপযুক্ত প্রয়োজনীয় উপাদানের অন্যতম উপাদান বৃক্ষের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। মানুষের অবহেলা ও উদাসীনতায় বৃক্ষ নিধনের ফলে বনের সীমারেখা ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে পড়ছে। যে পরিমাণে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে সে তুলনায় বনায়ন সৃজনে প্রত্যাশিত উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের প্রয়োজন।

বৃক্ষবিহীন জীবনের অভিশাপ মুক্ত হয়ে প্রকৃতির শোভাবর্ধন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের গুরুত্বকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে আমাদেরকে পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হচ্ছে ২৮ জুন তারিখটা সমগ্র বিশ্বে বিশ্ব বৃক্ষ দিবসহিসেবে পালন করা হয়। বৃক্ষরোপণ দিবসের স্লোগান হলো ফল বৃক্ষ করবো চাষ, কাটবো না আর একটি গাছ। অক্সিজেনে বেঁচে থাকি, দূষণমুক্ত জীবন গড়ি। এ বিষয়টি আমাদের চিন্তা চেতনায় জাগ্রত রেখে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে হবে। সমাজ, দেশ ও বৈশ্বিক স্বার্থে আমাদের বুঝতে হবে

বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, গাছ কাটলে সর্বনাশ। সকল মানুষ পশুপাখি, অক্সিজেনে বেঁচে থাকি।”

অবশ্য সরকারের পরিবেশ অধিদফতর প্রতিবছরের প্রতিপাদ্য বিষয় উল্লেখ করে ‘বিশ্ব বৃক্ষ দিবসস্মরণে রেখে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের আনাচে কানাচে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। যান্ত্রিক যানবাহন ও শিল্পকারখানায় দূষণ যুক্ত ধোঁয়ার বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পেতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এমতাবস্থায় কার্বন ডাই অক্সাইড মুক্ত শহর নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে অধিক সংখ্যক বৃক্ষ রোপণ করলে কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সচেতন জনগণ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দূষণ থেকে পরিবেশ বাঁচাতে কঠোর হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রকৃতির বিভিন্ন প্রান্তরে সবুজ বনানী সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্তত দুটি বৃক্ষ চারা রোপন করার বিষয়ে জোর আহবান জানাচ্ছেন। প্রাণী জগতের ভারসাম্য রক্ষায় এবং জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্য বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই বনজ সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। অধিক সংখ্যক বৃক্ষ রোপণ করবো পরিবেশ রক্ষা করবো, ধরণী সুন্দর হোক মানুষসহ প্রাণীকুল স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকুক এসব স্লোগান হোক সকল মানুষের অন্তরের অনুপ্রেরণা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ। বর্তমানে রেক্টর, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ, মিরপুর, ঢাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবীণ অভিনেত্রী কামিনী কৌশল মারা গেছেন