গবেষণায় উন্মোচিত আর্টিমিয়া-লবণ সমন্বিত চাষ, উপকূলীয় অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা

চবি মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট

শামীম হোসাইন, চবি | শনিবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট দেশের মৎস্য ও লবণ শিল্পে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এটি হলো আর্টিমিয়া ও লবণ একসঙ্গে একই জমিতে চাষের পদ্ধতি, যা আগের মতো আলাদা আলাদা চাষের পরিবর্তে দ্বৈত উৎপাদন নিশ্চিত করে। গবেষণার মাঠ পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের বটতলায় অবস্থিত লবণ মাঠে। এ স্থানটি উঁচু ও সমতল হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে আর্টিমিয়া চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।

আর্টিমিয়া হলো লবণজলে বেড়ে ওঠা এক ক্ষুদ্র প্রাণী, যা মাছ ও চিংড়ির পোনা উৎপাদনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জীবন্ত খাদ্য। দেশের চাহিদার তুলনায় আর্টিমিয়া উৎপাদন খুবই কম হওয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। গবেষকরা বলছেন, উপকূলীয় লবণ মাঠে সমন্বিতভাবে আর্টিমিয়া ও লবণ চাষ করলে কৃষকের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে এবং স্থানীয়ভাবে আর্টিমিয়া সিস্ট ও বায়োমাসের চাহিদা পূরণ করা যায়। আর্টিমিয়া পানির বর্জ্য শোষণ করায় উৎপাদিত লবণের মান উন্নত হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েও সহায়তা করে, বলেন গবেষণা সহকারী রিকু রানী দেবী।

গবেষকদের মতে, আর্টিমিয়া চাষের মাধ্যমে লবণের গুণগত মানও বৃদ্ধি পায়। কারণ আর্টিমিয়া পানির দ্রবীভূত বর্জ্য শোষণ করে। উৎপাদিত আর্টিমিয়া বায়োমাস ও সিস্ট থেকে উচ্চ প্রোটিনযুক্ত ফ্লেক ফিড তৈরি সম্ভব, যা চিংড়ি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

নাহিল সরকার বলেন, আর্টিমিয়া এক ধরনের লবণজলীয় ক্ষুদ্র প্রাণী, যা পোনা উৎপাদনে অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণ চাষিরা এক জায়গায় সমন্বিত পদ্ধতিতে আর্টিমিয়া ও লবণ চাষ করে বেশি আয় করতে পারবেন। পাশাপাশি দেশের চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

গবেষণা দলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কাজ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, মাঠ পর্যায়ের কাজ ২০২৫ সালের জুলাইয়ে শেষ হয়েছে। এরপর অক্টোবরের মধ্যে চাষিদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও প্রকাশনা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৭০০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে এই সমন্বিত চাষ চালু করতে পারলে ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়নে এটি হবে বড় অর্জন, তিনি বলেন।

প্রকল্পের সহযোগী অধ্যাপক আয়শা আক্তার বলেন, আমাদের লক্ষ্য আর্টিমিয়া থেকে বায়োমাস ও সিস্ট উৎপাদন এবং সেগুলো থেকে ফ্লেক তৈরি করে পোনা উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য খাদ্য তৈরি করা। এতে চাষিদের আয় বাড়বে, লবণের মান উন্নত হবে এবং প্রজনন কেন্দ্রগুলো সচল থাকবে। সঠিকভাবে কাজে লাগালে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, কর্মসংস্থান ও জীবনমান উন্নয়নে বড় অবদান রাখবে।

গবেষণা সহকারী আলম পারভেজ জানান, দেশের কৃত্রিম মৎস্য ও চিংড়ি প্রজনন কেন্দ্রগুলোতে আর্টিমিয়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা বর্তমানে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আর্টিমিয়া বায়োমাস ব্যবহার করে ফ্লেক তৈরির মাধ্যমে সারা বছর সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্ভব। চাইলে সাশ্রয়ী মূল্যে শেড তৈরি করে বছরজুড়ে উৎপাদনও সম্ভব।

অন্যদিকে হোমায়রা আক্তার বলেন, একই মাঠে আর্টিমিয়া চাষের মাধ্যমে দ্বিগুণ লাভের সম্ভাবনা তৈরি হয়। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এটি বড় ভূমিকা রাখবে। যেহেতু আর্টিমিয়া ছাকন পদ্ধতিতে খাদ্য গ্রহণ করে, তাই পানি ও মাটি পরিশোধিত হয়, ফলে লবণের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রকল্পপ্রধান অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করা, যাতে চাষিরা উৎপাদিত আর্টিমিয়া, সিস্ট, বায়োমাস ও লবণ বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে পারে। গবেষণায় আগ্রহীরা সহযোগিতা পাবে। সরকারি প্রণোদনা পেলে বাংলাদেশেও এটি সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংযোজন হলো নতুন ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনসহ উন্নত যন্ত্রপাতি
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে পরিত্যক্ত স্থানে মিলল কাপড়ে মোড়ানো বিপুল অস্ত্র