গল্প বলার গল্প

নাসের রহমান | শুক্রবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

এরা গল্প বলার জন্য অপেক্ষা করে আছে। একটু পরে গল্প বলা প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। এক ধরনের অস্থিরতা। কারো কাছে গল্প বলার উৎফুল্লতা নেই। আনন্দ ও নেই। গল্পটা কেমন হবে তা নিয়ে এদের ভাবনা। অনেকে মনে মনে গল্প বলতে থাকে। কেউ কেউ আবার ঠোঁট নাড়ে। কারো কোনো শব্দ হয় না। সামনে তিনজন বিচারক বসে আছে। পাশে একজন সহকারি। হাতে প্রতিযোগিদের নামের তালিকা । ছেলে মেয়েরা তার দিকে উৎসুক নয়নে তাকায়। কখন ডাক পড়ে।

এটা একটা স্কুলের ক্লাস রুম। বেঞ্চগুলো পুরানো। চেয়ার টেবিলও। স্কুলটাও অনেক পুরানো। তবে ক্লাসের জানালা দিয়ে গাছপালা দেখা যায়। সবুজ লতাগুল্মও। পাখিদের আনাগোনা চোখে পড়ে।

সহকারি তালিকা থেকে প্রথম প্রতিযোগীর নাম ধরে ডাকে। প্রতিযোগী বিচারকের সামনে এসে দাঁড়ায়। বিচারকরা নাম, কোন ক্লাস পড়ে, মোবাইল নম্বর ও স্কুলের নাম শিটে লিখে নেয়।

এবার গল্প বলা শুরু হয়। ছেলেটি গল্প বলতে থাকে। বিচারকরা শোনে। ভালো করে শোনে। তাদের মার্কিং করতে হয়। প্রতিযোগীরাও শোনে। কিরকম গল্প সবাই শুনতে চায়। গল্পে দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, আনন্দ থাকে, উপদেশ থাকে। আরো কতকিছু থাকে। বিচারককে অনেক কিছু দেখতে হয়। গল্পটি কেমন। ভাষা ও উচ্চরণ কিরকম। তার এক্সপ্রেশন দেখতে হয়। বলার ধরণ বা উপস্থাপনার দক্ষতা বিবেচনা করে নম্বর দিতে হয়।

একের পর এক প্রতিযোগী গল্প বলে যায়। বেশিরভাগই প্রচলিত গল্প। ভূতের গল্প, পরীর গল্প, রাক্ষসের গল্প, নীতিকথার গল্প, সততার গল্প, রাখাল বালকের গল্প, কুঁজু বুড়ির গল্প, ভাল্লুকের গল্প, সিংহ ও ইঁদুরের গল্প, কুমিরের গল্প, শিয়ালের গল্প। আরো কতরকম গল্প শোনাতে থাকে। বলার সময় এদের উৎকণ্ঠা আর থাকে না। অস্থিরতাও কেটে যায়। কেউ কেউ খুব চমৎকার করে বলে যায়। যেন নিজেরা গল্পের ভেতর ঢুকে যায়। অন্যদেরকে গল্পের মাঝে নিয়ে যায়। এমনকি বিচারকরাও গল্পের স্বাদ পায়।

কেউ গল্পের মাঝে কবিতার লাইন বলে। কেউ ছড়া কেটে গল্প বলে। আবার কেউ গল্পের সংলাপ অভিনয় করে বলে। একটি মেয়ে পুরো গল্পটা অভিনয় করে বলে যায়। সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। বিচারকরা নম্বর দিতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। গল্প বলা আর অভিনয় এক কথা নয়। গল্পতো গল্পই। কোনো লেখকের লেখা গল্প। এরা এমন করে বলে যায় যেন গল্প নয়। গল্পের চেয়ে বেশি কিছু। আবার কেউ কেউ যেন এ গল্পের ভেতর দিয়ে এখানে এসেছে। গল্পটিকে এরা এদের মতো করে নিয়েছে। এরা যেন নিজের গল্প বলতে শুরু করেছে।

এবারের প্রতিযোগিতা মাইলস্টোন ট্রেজেডির একটি গল্প শোনায়। স্কুলের সে মেয়েটির স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর। আহা কি সুন্দর ডানা মেলে পাখিরা আকাশে উড়তে পারে। আমার যদি পাখা থাকতো আমিও উড়ে উড়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যেতাম। নীল আকাশে পাড়ি জমাতাম। পাহাড় পর্বত সাগর নদী সব পার হয়ে যেতাম।

স্বপ্নটি যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। বিমানটি যে হঠাৎ একদিন তার স্কুলে নেমে আসবে তাও কেউ কল্পনা করেনি। বিমানটি দানবের মতো মেয়েটিকে ক্লাস থেকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গেলো। আকাশের একেবারে শেষ সীমানায়। যেখানে মেঘ আর রোদ্দুর খেলা করে। জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়ে যায়। সেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসতে পারে না। মেয়েটি এখন স্বপ্নের মতো আকাশের নীলিমায় ভেসে বেড়ায়।

গল্প শোনে কারো কারো চোখ জল এসে যায়। কেউ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। বিচারকরাও ভাবনায় পড়ে যায়। গল্পতো নয় যেন বাস্তব ঘটনা। সবগুলো গল্প দাগ কাটে না। এ গল্প যেন অনেকের মনে দাগ কাটে।

এর পরে আসে ছোট্ট একটি মেয়ে। সে সামনে দাঁড়িয়ে বলে আমার নাম প্রাচী। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আমার স্কুলের নাম অনাথ আশ্রম বিদ্যাপীঠ। আমি আমার নিজের গল্পটি বলতে চাই। বিচারকরা মেয়েটির দিকে তাকায়। সে বলতে শুরু করে।

আমি একটি অনাথ শিশু। আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে। আমার কোন পরিচয় নেই। আমার বাবা মাকে আমি জানি না। আমার আশ্রমও জানে না। হয়তো কেউ জানে না। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কি করে এসেছি। এসবের কিছুই লেখা নেই। আশ্রমের খাতায় লেখা আছে, কুড়িয়ে পাওয়া শিশু। এসব নিয়ে আমার তেমন ভাবনা নেই, কষ্টও নেই। সেদিন যদি কেউ কুড়িয়ে না পেতো তাহলো তো পথ শিশু হয়ে যেতাম। পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। দ্বার দ্বারে ভিক্ষা করতাম। ছিন্নমূল শিশু হয়ে থাকতাম। আর পথ খুঁজে পেতাম না। এখনতো একটা আশ্রয় আছে। থাকা খাওয়ার জায়গা আছে। পড়া লেখার সুযোগ আছে। চাইলে খেলাধুলাও করতে পারি। আর কি চাই। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আশ্রমের ভেতর বিদ্যা নিকেতনে পড়েছি। ওখানে শুধু আশ্রমের অনাথ শিশুরা লেখাপড়া করে।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে আশ্রমের বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়েছি। এখানে বাইরের অনেক ছেলেমেয়েও ভর্তি হয়। ক্লাস শুরুর কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম বাইরের ছেলে মেয়েরা আশ্রমের ছেলে মেয়েদের সাথে খুব একটা মিশে না। সহপাঠি হিসাবেও তেমন মেনে নিতে চায় না। এতোদিন আশ্রম থেকেও এরকম কিছু চিন্তা মাথায় আসেনি। স্নেহ মায়া মমতা এসব নিয়েও কখনো ভাবা হয়নি। এসব ছাড়াও শিশুরা বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এসবের শূন্যতা কখনো পূরণ হয় না। চিরকাল এ শূন্যতাকে বয়ে বেড়াতে হয়। যখন কোন সহপাঠি জানতে চায়, তোমার বাবার নাম কি? তোমার মাকে কখনো দেখেছো? তখন অসীম শূন্যতায় মনটা হাহাকার করে ওঠে। এক ধরনের বোবা কান্নায় ভেতরটা তোলপাড় করে। সহপাঠির প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাই না।

প্রতিযোগিরা মন দিয়ে শোনে। তাদের মনটাও খানিক ভারী হয়ে যায়। বিচারকরা মন দিয়ে কোনো কিছু বিচার করতে পারে না। তারা দেখে গল্প হয়ে উঠেছে কিনা। তবে তারা বলে, গল্পের বাইরেও গল্প আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুন্নীয়তের আদর্শ ও শিক্ষার প্রচার প্রসারে শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধশতবর্ষে সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ ও বর্তমান পৃথিবী