পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শব্দ ‘মা’ : আমার চেতনায়, আমার অস্তিত্বে

ডা: মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর সুব্‌হে সাদেকের সময়, যখন মুয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠে ভেসে উঠল আযানের সুর, পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠল সকালের সফেদ আকাশ, ঠিক তখনি আমার প্রাণপ্রিয় আম্মাজানের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে, চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমরা ৪ জোড়া ভাইবোন বিলাপ করে কাঁদি, হাতড়ে খুঁজি প্রিয় আম্মাজানের পবিত্র মুখখানি, দুধেল স্পর্শে বিলিয়ে দিই অতীতের দিনগুলো। বাতাসে কফিনের গন্ধ, বেহেশ্‌তী খুশবো’য় বিচ্ছুরিত সারা ঘরময়। সমস্ত কষ্টের সড়ক মাড়িয়ে সমূহ আনন্দকে আলোকিত করে তুলি আমরা ক’জন। পাড়াপড়শীর চোখে দেখি বেদনার দীর্ঘ জলোচ্ছ্বাসআবাসন আমাদের প্রতিবাদী ওঠোন, দোয়েলকোয়েলদের চেঁচামেচিতে নি:সরিত হয় চতুর্থ ট্রফোস্পিয়ার। হাজারো গুণে গুণানিত্ব আমার ‘মা’ তৎকালীন যুগের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আমীর আলী ছাহেবযাঁর শিষ্য ছিলেন মুফতী ফয়জুল্লাহ্‌ (.) (প্রতিষ্ঠাতা, মেখল মাদ্রাসা, হাটহাজারী), তাঁর আদুরে দ্বিতীয় কন্যা ছিলেন আমার প্রিয় আম্মা। একদিন চবি লোকপ্রশাসন বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর (সিলেক্‌শন গ্রেড প্রাপ্তঅতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার) আবদুন্‌ নুর স্যার (যিনি এখন মাটির দেশে বসবাস করছেন) এর আব্বাজানের কথা বলতেই আম্মা বলে উঠলেন, ‘হাতকাটা হাফেজ কাদের’শুনে তাজ্জব বনে গেলাম।

৮৫ বছরের এ অশীতিপর বৃদ্ধার কেমন স্মৃতির প্রখরতা, এমনি বহু পুরনো ঘটনা আমার আম্মা বলতে পারতেন। যা শুনে আমরা ভাইবোনেরা অবাক হয়ে যেতাম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও খালি চোখে পড়তে পারতেন পবিত্র কুরআনুল করিমের সূরা/ আয়াত সমূহ। দু’দুটি দুর্ঘটনা আমার আম্মার জীবনকে দিয়েছে শেষ দিনের সুসংবাদ, শরীরের সবচেয়ে লম্বা অস্থি ঋবসঁৎএর ঘবপশ ঋৎধপঃঁৎব, এ বয়সে হওয়াটা স্বাভাবিক, তাই হলো। কোন একদিন ফজরের নামাজের সময় নিজ বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। মেহেদীবাগস্থ ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো আম্মাকে। কন্‌সালটেন্ট অর্থোপেডিক সার্জন প্রফেসর ডা: হোসেন আহমদ ও বন্ধুবর ডা: এটিএম রেজাউল করিমের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ সার্জন টিম অস্ত্রোপচার করলেন, সুস্থ হলেন। নিজস্ব আবাসে ফিরে গেলেন সহসাই। কিন্তু অমানিশার ঘোর আঁধার কাটে না, নির্জলা আঁধারের ভেতর বেড়ে ওঠে কৃত্রিম আকাশ, অপরিণত আবেগ। দু’সপ্তাহের ব্যবধানে নিজে নিজে ডধষশবৎএর সাহায্যে হাঁটতে গিয়েই ঘটলো চরম বিপত্তি। পৃথিবীর চাঁদগুলো খসে পড়ে মাথার উপর, গর্ভবতী প্রেম তখন লক্ষ কিলোমিটার দূরে, যোজন যোজন দূরত্বে চলে যায় নিশ্চিদ্র অহংবোধ, রচিত হয় একটি সম্পূর্ণ ইতিহাস, শ্রদ্ধার্ঘ্য আর ফুলেল মৃত্তিকা।

আবারো ন্যাশনাল হাসপাতালমাত্র চার দিনের মাথায় অস্ত্রোপচারআর্থিক জৌলুস আর পার্থিব সুখবিলাস তখন আমার সংসারে। সাতকানিয়া আশশেফা হাসপাতাল থেকে দ্রুত চলে আসি (ঐ দিন ছিল জুমাবার) অস্ত্রোপাচার কক্ষ করিডোরে, দেখি একজোড়া প্রিয়মানুষ পায়চারি করছেন উর্দ্ধশ্বাসে সহাস্য বদনে অভিনন্দিত হই আমি। একজন অকৃতজ্ঞ ছেলের প্রিয় আম্মাজান অপারেশন টেবিলে, নাটোরের বনলতা সেনের মতন জ্বল জ্বল করছে দু’টি চোখসারা পৃথিবীর অশ্রু যেন রেটিনার গভীরে, পোষ্ট অপারেটিভ রুম থেকে কেবিনে নিয়ে আসি আম্মাকে২১ নভেম্বর’১৪ শুক্রবার সন্ধ্যায় অবস্থার অবনতি ঘটে। বন্ধুবর ডা: হারুনঅররশিদ এর পরামর্শক্রমে আইসিইউতে স্থানান্তর করি। সারারাত নি:সঙ্গ, একাকী, ৯০ বছরের পরহেজগার একজন মা শুয়ে আছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বিছানায়, অভাগা আমরা ৮ ছেলেমেয়ে কেউ ছিলাম না সাথেঘুম পাড়ানী মাসিপিসির গল্প শোনাতে শোনাতে যিনি আমাদের ঘুম পাড়াতেন, আপাদমস্তক ভেজা সমস্ত দস্তারখানা, চাদর, নিষ্ঠুর হননি কখনো, ঝর্ণাধারার হাসিতে মিশে যেত বেদনার মুহূর্তগুলো। সেই মাকে একা ফেলে আমরা সবাই শান্তির নীড়ে, বেহেশতী বালাখানায়, নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। ২২ নভেম্বর নিজস্ব কর্মস্থল রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালঅবস্থান শেষে সরাসরি ন্যাশনাল হাসপাতালএকপলক দেখেই। অর্থনীতির আবরণ ভেদ করে বাতাসের গতির সাথে মেট্রোপলিটন সড়ক দিয়ে হাঁটি। রাতে এসে দেখি, ছোট্ট শিশুর মতন ঘুমাচ্ছেন আমার প্রিয় মা, যাঁকে সময় দিতে পারিনি পর্যাপ্ত, আগ্রহী হয়ে ওঠেন দু’টি বাক্য বলার জন্য। পেশাগত ব্যস্ততা আর পৃথিবীর প্রাচুর্যের কাছে রীতিমত অসহায়। আফসোস প্রিয়তমা মাএর পাশে বসে দু’চারটি কথার বলার অদম্য ইচ্ছা আর হয়তো কোনদিন হবে না। কেমন নিষ্ঠুর এই আমি এই রাতটুকুন কাটাতে পারিনি আম্মার সাথে, চলে গেলাম অক্সিজেনস্থ আবাসে। লুৎফা আপার টেলিফোনে ভেঙ্গে গেল আনন্দের ঘুম।

হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠলো বুঝার বাকি নেইআমার মাআর নেই। এক নিঃশ্বাসে ছুটে গেলাম ন্যাশনাল হাসপাতাল পানে। অবুঝ শিশুর মতন মৃত্যুর বিছানায় একজন গর্ভধারিনী মা, যাঁকে আর কোন দিন মা বলে ডাকতে পারবো না। ধীরে ধীরে শোকের রাজপথ হয়ে ওঠে সংক্ষুদ্ধ, তপ্ত যৌবনের আলোকিত রশ্মিআত্মীয়স্বজনদের আনাগোনা: বেদনার ছায়াপথকে ঘিরে ধরে সবাই যেন। করুণ সাইরেনের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে দলিলাবাদ গাঁ, জীবনের পঁচাত্তরটি বসন্ত কেটেছে আমলকির পাতায় পাতায়, প্রিয় মুখখানি দেখে হু হু করে ওঠে শিশু, যুবা, বৃদ্ধা সবাইযেন অনেক দিনের চেনা ইউক্যালিপ্‌টাস। যাবতীয় ধর্মীয় কর্মসম্পাদন শেষে আম্মাজানের কফিন নিয়ে ছুটে চললাম কবরস্থানের দিকে যেখানে আমার মরহুম আব্বাজান শুয়ে আছেন, যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ৯০’ এর ১৫ মার্চের কোন এক শিশিরভেজা সকালে। আব্বার পাশে শায়িত করে এলাম আম্মাকে, আমার নানার প্রতিষ্ঠিত রাউজান এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার পার্শ্বস্থ কবরস্থানে প্রিয় আম্মাজানকে রেখে আসলাম অতি সন্তর্পণে। জানাযায় ইমামতি করেন হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার পরিচালক বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার আল্লামা আহমদ শফী (মরহুম)। কানায় কানায় পূর্ণ এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসা চত্বর। যে মাদ্রাসায় আমার নানার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসতেন আম্মাজান কৈশোরকালে। স্মরণকালের বৃহত্তম এই জানাযায় সর্বস্তরের মানুষদের অংশগ্রহণ আমাদের শোককে ভুলে যাবার পথকে করেছে প্রশস্ত।

হঠাৎ বন্ধ পাখীদের কলকাকলি, বিশুদ্ধ বাতাসেরা গতি হারিয়ে লুটোপুটি খায় নিষিদ্ধ শহরে। ‘মা’আমায় ক্ষমা, করোএ পাপী ছেলের জন্য স্বার্থপরের মতন শুধু নিজেকেই বিলিয়ে দিয়েছি নিজের মাঝে, কতই না আশা ছিল ছেলে আসবে, হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতন পেছন পেছন যাবে সাহসী সময়, ফুৎকারে উবে যাবে ছায়াগুচ্ছ, সমুজ্বল ক্যান্সার। কোন এক নিষিক্ত সকালে এসেছিলাম নিজস্ব বাড়ির আঙ্গিনায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসির রেখা আমার মা’র মুখ, সৃষ্টির পুষ্পিত সৌরভ সারাবেলা। বিদগ্ধ আবাহনে মিশে যায় আমাদের সবার অতি আপনজন ‘মা’বেলাঅবেলার কথা শেষে এবার যাওয়ার পালা, নাহ্‌ যেতে দেবেন না, তবুও যেতে হয়, পেশাগত সড়কে তখন শবমিছিল, একটু বসো বাবা ‘অ’ ফারুভেতর থেকে উল্লাসে ফেটে পড়ি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, লবনাক্ত সংসারের কড়চাপেছন পেছন লাঠি ভর দিয়ে এক বৃদ্ধার যাত্রা বিরতিঅদৃশ্যমান হলেই যেন প্রস্থানঅনেক, অনেক, ভালোবাসার কথামালা লুকিয়ে রেখেছিলো মাটির পাতিলে। বলা হয়নি সবকথাযার মাঝে ছিল পবিত্রতার মশাল আর একটি আলোকিত সকাল। হজ্ব থেকে ফিরলাম, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমার অনেক দিনের ইচ্ছা পুরণ করলেনএলোমেলো জীবনটাকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি শুদ্ধতার ঘেরাটোপে।

এমনি দিনে একজন হারা এখন আমি। আমার ‘মা’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শব্দঅকৃত্রিম ভালোবাসার মাইলপোস্ট, হৃদ্যতার মেলবন্ধন। আমার অন্যরকম প্রতিবিম্ব দেখে আনন্দিত হতেন, আন্দোলিত হত তাঁর পুরো শরীর, হাত তুলে দোয়া করতেন এ’ অভাগা ছেলের জন্য। এখনো আমার মা’কে খুঁজি দলিলাবাদ গ্রামে পাতায় পাতায়, গুল্মে গুল্মে, লজ্জাবতীর পরতে পরতে ও দু:স্থ মানবতার হৃদয়ে হৃদয়ে, যাঁদের তিনি সবচে’ বেশী ভালোবাসতেন, অকাতরে বিলিয়ে দিতেন সবকিছু, ফিরিয়ে দিতেন না কাউকেইতাইতো আম্মার প্রতিদিনের সকালের আসর ছিল তাঁদের কে নিয়ে পানমুখে একগাল ভরা হাসিতে মুখরিত হতো বাড়ীর ওঠোন।

অবহেলিত মানুষদের ভালোবাসা, দোয়া আর তাঁর নেক্‌কার জিন্দেগীর কারনে মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন হয়তো তাঁকে দান করবেন সবচাইতে সম্মানিত স্থান, অধিষ্ঠিত করবেন বেহেস্তের শ্রেষ্ঠতম অঞ্চলে। পাশের বাড়ীর চাচী (আলী আকবরের মা)- বেতবনে নিক্ষিপ্ত কৈশোরকাল। সহাস্যবদনে বিশ্বাসেরা মিশে যায় তারুণ্যের মেঘমালায়, যুথবদ্ধ ইশারায় এই আমি, যেন চেনাঅচেনার বিমূর্ত সমীকরণ। সারাবেলা ছিলাম শৈল্পিক অট্টালিকায়। ধীরে ধীরে গর্ভবতী আমার ব্যক্তিগত মনন, চেতনার বাতিঘর। পরে বুঝলাম আমি, আমিই অন্যরকম এক প্রতিকৃতি। চাচী আমায় ক্ষমা করো। আমি ফিরে যাচ্ছি নৈ:শব্দের কোলাহলে, সূর্যের শহরে।

লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার বাবা অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান
পরবর্তী নিবন্ধজীবনানন্দের কবিতায় কণ্ঠ দিলেন শুভমিতা