সোনারোদের ঝলমলে দুপুর শেষে টুপ করে আলো মিইয়ে যাওয়া, অমনিই বিকেল বলে আর কিচ্ছু থাকে না। গোধূলি, সন্ধ্যা সব একাকার করে নিকষ কালো অন্ধকার হয়ে আঙিনায় নেমে আসে রাত। যেনো অভিমানী কিশোরীর হঠাৎ খলবলিয়ে হাসির পর অযাচিত অভিমান, এই হাসি এই তার মন ভার।
দিনের আলোতেও কেমন একটা আলো ছায়া খেলা করে, হয়তো টুপ করে একটু বৃষ্টি। কিন্তু বাতাসের টান হয়ে ওঠে তীব্র। কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি, মন কেমন করা বিকেল। এই সেদিন দেখা গেলো গাছ ভর্তি ছাতিম, সপ্তাহ পেরোতেই ছাতিম সব ঝরে গাছের কোল খালি হয়ে গেলো। তীব্র তাড়া তার, সে স্থির হতে চায় মুহূর্তের জন্য। এদিকে সবজির চেহারা হয়ে উঠছে সুন্দর, লাবণ্য আসতে শুরু করেছে তাদের শরীরে। ঝরা পাতার তীব্র হাহাকারে বাতাস যেনো কাঁদে নিভৃতে, তার কান্না শুনতে পাওয়া যায় একটু কান পাতলেই, একটু অনুভবে।
ভীষণ জীবনানন্দ মনে পড়া শেষ বিকেলে টুপ করে নেমে আসে রাত। তখন দিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে ধানক্ষেতের সোঁদা গন্ধে জোনাকি দেখতে মন চায়। মাথার ওপর চাঁদ আর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত, সোঁদা গন্ধ, শিশিরের আদ্রতা, ঝিঁঝি পোকার অনর্গল বকে যাওয়া, কোথাও শিউলির মাতাল গন্ধ অথবা ছাতিমের। এই হলো হেমন্ত!
প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গে হেমন্তকে চেনার পাশাপাশি বাঙালি সাহিত্যরসিকেরা হেমন্তকে উচ্চারণ করে জীবনানন্দকে সাথে নিয়েই। কারণ বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ ছাড়া হেমন্তের এমন প্রিয়জন আর কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। তিনি হেমন্তকে ভালোবেসেছেন। এতটাই ভালোবেসে গেলেন, যেখানে হেমন্তকে উচ্চারণ করতে গেলে জীবনানন্দের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠে, তারা একে অন্যের সাথে এতটাই অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত।
জীবনানন্দের সমগ্র সাহিত্যে তিনি সবচে বেশি জোর দিয়েছেন সাধারণত প্রকৃতির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অনুষঙ্গ সমূহকে। সেখানে বাদ পড়েনি কিছুই।
তিনি এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়সমূহকে তাঁর উপস্থাপনার মাধ্যমে এত উচ্চতর মার্গে তুলে ধরেছেন, তাতে পাঠক মাত্রই বিমুগ্ধ হয়।
অথবা বলা যায়, বাংলা সাহিত্যধারা সমৃদ্ধ হয়েছিলো তাঁর এসব প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের প্রকাশ শৈলীতে। প্রাকৃতিক নানা অনুষঙ্গের মধ্যে তিনি ‘শিশির’র কথা উল্লেখ করেছিলেন সবচেয়ে বেশি। হেমন্তের নানা আবর্তনে হোক বা প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপমায় হোক, তিনি বারবার এনেছেন শিশিরের কথা। একটি শব্দের এত বহুমাত্রিক ব্যবহার, জীবনানন্দের পক্ষেই সম্ভব।
কবি খুব সচেতন ভাবেই শিশির শব্দের ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ভাবে। সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে কখনও কখনও শিশিরকে ব্যবহার করেছেন তিনি।
কখনও শিশির ব্যবহৃত হলো নিঃশব্দতার প্রতীক হিসেবে। শিশির কখন জমে ওঠে ঘাসের ডগায়, তা কেউ টের পায় না। কিন্তু তাতে আলোকচ্ছটা পড়লেই তা চিকচিক করে ওঠে।
আমাদের জীবনটাও ঠিক এমনই। জীবনে শিশির রূপী সময় কখন আসে কখন যায়, তা টের পাওয়া যায় না। নিঃশব্দে তার আসা যাওয়া। তাতে আলোকচ্ছটা পড়লেই আমরা তার অস্তিত্ব বুঝতে পারি।
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;’
অথবা,
‘সোনালি–সোনালি চিল
শিশির শিকার ক‘রে নিয়ে গেছে তারে
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!’
জীবনানন্দের সমগ্র সাহিত্যে মূল আলোর ছটা ছিলো শুধু হেমন্ত ঋতুর ওপর। বেশির ভাগ কবিতাতেই হেমন্তের এমন আধিপত্য দেখা যায়। তাই হেমন্তের কুয়াশা, শিশির, ধানক্ষেত এবং বিষণ্নতা প্রধান বৈশিষ্ট্য।
‘পেঁচা’ কবিতায় তিনি ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল’!
অথবা,
‘অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে’ পংক্তিগুলোর মাধ্যমে হেমন্তের শান্ত, বিষণ্নতার চিত্র এঁকেছেন। তাঁর কাছে ছিল এসব প্রকৃতির একটি বিশেষ মুহূর্ত, যা তাঁর কবিতায় রহস্য, নিস্তব্ধতা এবং বিষাদের ছায়া নিয়ে আসে।
‘অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু।’
বাংলা সাহিত্যে হেমন্তকে নিয়ে এমন রোমান্টিক উক্তি আর কয়টা আছে।
কোথাও বা বলেছেন–
‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল,
এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে–উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
………..
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’
স্মৃতি জাগানিয়া অমর বিখ্যাত কয়েকটা পংক্তি, কী অদ্ভুত, চমৎকার একটা অনুভূতি মনে জাগিয়ে তোলে।
তিনি বলেছিলেন–
‘শিশিরভেজা ঘাসের গন্ধে ভোরের নরম হাওয়া বয়,
মনে হয় পৃথিবী আজ নতুন করে বাঁচতে চায়।’
তাঁর কাব্যজগতে প্রকৃতি যেমন নীরব, তেমনি গভীর। তিনি লিখেছেন–
‘ফিরে এসো, নক্ষত্রহীন রাতে,
শিশিরভেজা ঘাসে দাঁড়িয়ে থাকি একা।’
ধূসর পাণ্ডুলিপির নির্জন স্বাক্ষর কবিতায় বলেছেন–
‘আমার বুকের ’পরে/ সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই; শুধু তার স্বাদ/তোমারে কি শান্তি দেবে; আমি ঝরে যাবো, তবু জীবন অগাধ/তোমারে রাখিবে ধরে/ সেইদিন পৃথিবীর ’পরে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে’।
শিশিরের নিঃশব্দে ঝরে পড়ার মতোই জীবনানন্দের নীরবে পথ চলা। আবার শিশিরের মতোই তাঁর নীরবে চলে যাওয়া।
কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো না তাঁর।
নীরবে, নিভৃতে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের মাধ্যমে নিজের মনের একান্ত অনুভূতিকে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন কাব্যিক মহিমায়।
তীব্র অনুভবে অনুভব করতেন প্রকৃতিকে। তাই প্রকৃতি তাঁকে নিরাশ করেনি, তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে, তাঁর সৃষ্টিকে করে তুলেছে পরিপূর্ণ। এমন আনকোড়া বিষয়ে, অন্যরকম উপমাতেও ভালোবাসার মতো রোমান্টিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত সম্ভব তা তিনি দেখিয়েছেন। বিরহের বিষাদেও যে প্রকৃতি সাথী হতে পারে তাও বুঝিয়ে দিলেন জীবনানন্দ স্বয়ং। আসলে জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে জীবনানন্দ শুধু মাত্র প্রকৃতিকে অবলম্বন করে এসেছেন। জীবনানন্দ হেমন্তের এমন নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। আর তাতে করে হেমন্তের এমন অপ্রকাশিত রূপ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেলো সাহিত্যরসিকেরা। তারেক অণু জীবনানন্দ দাশকে ‘অব্যক্তের কবি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা তাঁর কবিতার গভীর ও অব্যক্ত অনুভূতিকে প্রকাশ করে। তিনি জীবনানন্দের কবিতায় কল্পনার সাথে বাস্তবতার এক চমৎকার মিশ্রণ খুঁজে পেয়েছেন, যা তাঁর লেখাকে অনন্য করে তুলেছে। আমরা সাধারণ চোখে যা দেখি জীবনানন্দ সেই সাধারণকেই অসাধারণ করে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন, আমরা মুগ্ধ হয়েছি– আজ এত বছর পরেও যে মুগ্ধতার রেশ কাটেনি।
লেখক: প্রাবন্ধিক।









