“এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” কবি হেলাল হাফিজের “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কবিতার কালজয়ী একটি অমর লাইন। এ কবিতায় উদ্বুদ্ধ হয়েই যেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের নলান্দা গ্রামের এ বীর কৃতি সন্তান মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭৫ পরবর্তী জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান বিদেশে। ৩০ বছর প্রবাস জীবন অতিক্রম করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনদিন চিন্তা করেননি একটি সার্টিফিকেট কিংবা কারো স্বীকৃতি। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছর পর দেশে ফিরে আস্তে আস্তে যেন ফিকে হয়ে আসছে কর্মক্ষমতা। হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি সহ সবকিছু। সোনালী যৌবন হারিয়ে বাস্তবতার বার্ধক্যকে আলিঙ্গন করেই কর্মহীন জীবন শুরু করলেন। নানা রোগব্যাধি শরীরে বাসা বাঁধতে লাগলো। যার প্রেক্ষিতে অলস সময় পার করতে হচ্ছে তাকে। এসময় মনে আসলো, অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেল, পেল সার্টিফিকেট সহ কতকিছু। আমি তো কারো কাছে কোন কিছুই চাইনি। এখন যদি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতিটা পাই, অনন্ত জীবনের শেষ সময়ে একটি সম্মান নিয়ে বিদায় নিতে পারবো।
মনের অজান্তে এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়ার পরই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতির জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন, সহযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে আবেদন নিবেদন করতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে নানা রোগ–শোকে আক্রান্ত হয়ে অবশেষে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শুক্রবার দুপুর ১.১৫টায় জীবন প্রদীপ নিভে গেল বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদের। জীবন সায়েহ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি সরকারী স্বীকৃতি না পাওয়া আক্ষেপ নিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি আর ফিরবেন না। কোন দপ্তরে গিয়ে স্বীকৃতির জন্য আর ধর্ণা দিবেন না বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ। এভাবেই অন্তরের একটি অপ্রাপ্তি নিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি।
রফিক আহমদের পুত্র মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক এরশাদ ও পটিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়াসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম কাতারের সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, পটিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও দিশারি খেলাঘর আসরের উপদেষ্টা মোজাম্মেল হক এরশাদ এর পিতা, বোয়ালখালীর প্রথম শহীদ এখলাছুর রহমানের ভগ্নিপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ (৮২)।
তিনি চরকানাই প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে ১৯৬৫ সালে চরকানাই বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্টিক পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে এইচ এস.সি, ১৯৬৯ সালে বোয়ালখালী কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে বি.কম, স্বাধীনতাত্তোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রীতে অধ্যয়ন করেন।
ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের নেতাদের অতি পরিচিত মুখ ও সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর সমসাময়িকের মধ্যে প্রয়াত চৌধুরী হারুনুর রশীদ এমপি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মহসীন খান, বোয়ালখালীস্থ উপ পুলিশ কমিশনার কবি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইউনুচ এর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি বোয়ালখালীর প্রথম শহীদ এখলাছুর রহমানের ভগ্নিপতি, ছিলেন পটিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সাথে ছিলেন হামিদ, কাশেম জুট মিলের স্বত্বাধিকারী কাশেম, মহসিন খান প্রমুখ। ৬৯ এর গণঅভূথানে স্যার আশুতোষ কলেজে অধ্যয়নকালে ১১ দফা আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা রাখেন তিনি।
পরবর্তীতে ধারাবাহিক আন্দোলন সমূহে যোগ দিয়ে তাঁহার গ্রুপ কমান্ডার অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ৪০/৫০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বান্দরবান পাহাড়ি পথে কাপ্তাই সড়কের পদুয়া হয়ে দোভাষী বাজারে সমবেত হন। জীপ রওয়ানা হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উদ্দেশ্যে। গাজ্জালী কলেজ পার হয়ে শক্র পক্ষের আক্রমণের শিকার হলে দিলীপ চৌধুরীসহ কয়েকজন সহযোদ্ধাকে হারিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেন। এরপর পটিয়ার পূর্ব পাহাড়ে খুরুশিয়ার বাঘাইয়া চাকমার খামার বাড়িতে লাটি আলম ও হাবিলদার ইছহাকের অধীনে গেরিলা ট্রেনিং নেন। পরে এ এফ এম তোজাম্মেল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে মিজোরামের দেমাগ্রী ক্যাম্পে যোগ দেন। গ্রামীণ মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে, কখনো পাগলের বেশে দীর্ঘ পথ চলতে হয়। আইস ফ্যাক্টরি রোডে ও দোস্ত বিল্ডিংয়ে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন।
সাদাসিধে জীবনধারনকারী এই মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর অবদানের স্বীকৃতি মেলে নি! রাষ্ট্রীয় সম্মাননা থেকে বঞ্চিত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে হলো।
লেখক : সাংবাদিক, দৈনিক আজাদীর পটিয়া প্রতিনিধি










