শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করতে হবে

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী | বুধবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে প্রযুক্তি, শিল্প, এবং বৈশ্বিক চাকরির বাজারের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এখন শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হচ্ছে ফলাফলভিত্তিক শিক্ষায় বা আউটকাম-বেইজড এডুকেশনে। আউটকাম-ভিত্তিক সিলেবাস বর্তমান সময়ে শ্রমবাজারে চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদান করে। আউটকাম-ভিত্তিক সিলেবাস এমন একটি শিক্ষাপদ্ধতি যা শিক্ষার্থীদের শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতায় সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২০১০ এর শিক্ষানীতি অনুযায়ী বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই তাদের স্নাতক পাঠ্যক্রমে আউটকাম-ভিত্তিক সিলেবাস কাঠামো সংযোজন শুরু করেছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১১৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।তবে বাস্তব প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন এমন বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে যে সমস্ত বিষয়গুলোর কর্মজীবনে কোন পরিস্ফুটন নেই বা দেশে বিদেশে তার প্রকৃত কোন মূল্যায়ন নেই। এমনকি এসকল বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা কখনোই পূরণ হয় না, অপরদিকে অনেক বিভাগে ছাত্র ভর্তির চাপ থাকলেও অবকাঠামো এবং শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সেখানে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় না। আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে যে বিষয়ে পড়ালেখা করেছে সে সংশ্লিষ্ট চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতঅর্থে আমাদের দেশে যে বিষয়ে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে শিক্ষা গ্রহণ শেষে সে বিষয়ে তার কর্মসংস্থান হয় না । বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার হার যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে শিক্ষিত বেকার যা আমাদের শিক্ষার্থীদের দিন দিন বেকারত্বের অভিশাপে হতাশার অতল সাগরে নিমজ্জিত করছে।

জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এ দক্ষ ও কর্মমুখী স্নাতক তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পাঠ্যসূচি পুনর্গঠন করছে, যেখানে নির্দিষ্ট শেখার ফলাফল (learning outcomes) স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারে এবং বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা (OBE) শিক্ষাপদ্ধতি ধীরে ধীরে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নয়, বরং ব্যবহারিক দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি অর্জনে সহায়তা করা। এর ফলে স্নাতকরা শুধু পাঠ্যবইনির্ভর জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তারা তাদের পেশাগত জীবনে তা প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হবে।

আউটকাম-ভিত্তিক সিলেবাসের মূল বৈশিষ্ট্য: এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শেখার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, যা শিক্ষক-কেন্দ্রিক শিক্ষার তুলনায় তাদের চাহিদা ও লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে। শিক্ষার্থীদের কি জানা এবং কি করতে পারা উচিত, তা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতাকে পরিমাপ করে এটি নিশ্চিত করা হয় যে তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছে। পাঠ্যক্রম, শিক্ষকতা পদ্ধতি, এবং মূল্যায়ন কৌশলগুলো নির্দিষ্ট শেখার ফলাফল অর্জনের জন্য পরিকল্পনা তৈরী করা হয়, যেমন- প্রোগ্রাম আউটকাম নির্ধারণ, কোর্স আউটকাম তৈরি, পাঠ্যক্রমের নকশা ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। যা প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করা হয় যাতে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে সহায়তা করা যায়।

যদিও আউটকাম-ভিত্তিক সিলেবাসের উচ্চশিক্ষায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে তবুও এর কার্যকর বাস্তবায়নে নানা ধরণের প্রশাসনিক, কারিগরি, সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বলা যায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও আধুনিক শিক্ষণ সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, পরিবর্তন আনতে হচ্ছে শিক্ষণ-পদ্ধতিতেও কারণ ঙইঊ পদ্ধতিতে বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে দক্ষতা-কেন্দ্রিক শিক্ষার দিকে স্থানান্তর ঘটাতে হচ্ছে। বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এই পদ্ধতিকে একটি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক, দক্ষতা-নির্ভর এবং কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারি সহায়তা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে আরও আধুনিক, কর্মমুখী এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে তুলতে হবে। পাঠ্যক্রমকে শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদা এবং বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। সিলেবাস পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলেও শ্রমবাজার নির্ভর দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সে প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সমাঝোতা চুক্তি এবং সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহনে এগিয়ে আসতে হবে, উচ্চ শিক্ষা প্রদানকারী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সিলেবাসের অংশ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়ভিত্তিক ইন্টার্নি করতে হয় কিন্তু সেক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সেই ইন্টার্নি শিক্ষা প্রদানে অনেক সময় অনীহা প্রকাশ করে যা দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। বিশ্বে আমরা যে শ্রম শক্তি রপ্তানী করি সেটির অধিকাংশ শ্রমিক শ্রেণির, তাই চাহিদা অনুযায়ী উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি রপ্তানীতে আমরা অনেক পিছিয়ে তার কারণ আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সেভাবে বিভিন্ন কারণে তৈরী করতে পারছি না।

এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামের আয়োজন করে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বাধ্যতামূলক চুক্তি সম্পাদনের ব্যবস্থা করে তাদের তৈরী করতে হবে, তাহলে সকলের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরী হবে যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করবে। তথ্য ও পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমাদের শ্রমবাজারের প্রতিষ্ঠান সমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে চায়, তারা শ্রমবাজার নির্ভর জনশক্তি তৈরীতে বিনিয়োগ করতে চায় না অথচ ঐ প্রতিষ্ঠান সমূহ যদি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিতে সহযোগিতা করতো তাহলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরী হতো।

তাই শুধু উচ্চ শিক্ষার হার বৃদ্ধি করলে হবে না বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরী করতে হবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার অনুযায়ী শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি। অন্যথায় ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রতিযোগিতায় এই বিশ্বে দক্ষ শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়বো।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধওড়িশী অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টারের রজত জয়ন্তী