প্লট ফ্ল্যাট হস্তান্তর নিয়মে বড় পরিবর্তন

এখন থেকে লাগবে না পূর্বানুমতি ।। বন্ধ হবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে থাকা সিন্ডিকেটের ঘুষ বাণিজ্য

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষসহ সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রির অনুমোদন, হস্তান্তর ও নামজারি করার ক্ষেত্রে পূর্বানুমতির আর কোনো প্রয়োজন নেই। দেশের অন্যান্য জমি বা প্লট কিংবা ফ্ল্যাট যেভাবে সরাসরি রেজিস্ট্রি হয় এখন থেকে সরকারি সব প্লট ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রিও একইভাবে সম্পন্ন হবে। এতে বিভিন্ন দপ্তরে ওত পেতে থাকা সিন্ডিকেটের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দপ্তরে প্লট ফ্ল্যাট ট্রান্সফারে এক ভয়াবহ রকমের দুর্নীতি চলে আসছিল। লাখ লাখ টাকা ফি আদায়সহ কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য চলে আসছিল জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের অধীনস্ত বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়ে। আগে ট্রান্সফারের নামে একটি ঘর তৈরির নিয়মেও কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চালানো হতো। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থাকলেও তারা প্রতিরোধ করতে পারেনি।

সিন্ডিকেটের হাতে বাধ্য হয়ে মোটা অংকের ঘুষ তুলে দিয়ে প্লট ফ্ল্যাট ট্রান্সফার করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের টাকায় কেনা প্লট কিংবা ফ্ল্যাট সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছ থেকে ট্রান্সফার করার আগে বিক্রি করারই কোনো সুযোগ ছিল না। সংশ্লিষ্ট সংস্থার ট্রান্সফার অর্ডার পাওয়ার পরই কেবল রেজিস্ট্রি অফিসে উক্ত ফ্ল্যাট, প্লটের বিক্রয় কিংবা হেবার দলিল সম্পাদন হতো। সংশ্লিষ্ট সংস্থার ট্রান্সফার অর্ডার ছাড়া রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রিজিস্ট্রি হতো না, সহকারী কমিশনার (ল্যান্ড) নামজারি করতে পারতেন না। বিষয়টি নিয়ে মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছিল। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোও একই নিয়ম চালু করে। এমনকি বহু বেসরকারি আবাসন কোম্পানি তাদের কাছ থেকে কেনা ফ্ল্যাট কোনো জরুরি প্রয়োজনে বিক্রি করতে গেলে তাদের কাছ থেকে আগে ট্রান্সফার অর্ডার নেয়ার বাধ্যবাধকতা রাখে। নির্দিষ্ট ফি’র নামে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে এই ট্রান্সফার অর্ডার প্রদান করা হয়।

অবশেষে দীর্ঘদিনের অনাকঙ্ক্ষিত এই নিয়ম রোধ করা হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা ও বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও জনস্বার্থে গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয় বহুলপ্রত্যাশিত প্রজ্ঞাপনটি গেজেট আকারে জারি করেছে। গত রোববার সন্ধ্যায় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগএর উপসচিব ড. মো. নুরুল আমিন। এরপর প্রজ্ঞাপনটি গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য রাতেই বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কারের অংশ হিসাবে পূর্ত মন্ত্রণালয় এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে কোনো প্রভাবশালী চক্র এই সেবা কার্যক্রম সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও এসি ল্যান্ডের দপ্তর থেকে ফেরত আনতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সংশোধন করা হবে বলেও সূত্র জানায়।

গেলো রোববার রাতে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে ৭টি নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনের শুরুতেই বলা হয়েছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক উন্নয়নকৃত আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরপরবর্তী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সেবা সহজীকরণ, লিজগ্রহীতাদের দুর্ভোগ ও হয়রানি লাঘব এবং দুর্নীতি দূরীকরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান পদ্ধতি ও প্রথা পরিবর্তন করা হচ্ছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক উন্নয়নকৃত ও বরাদ্দকৃত আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান বা হেবা সূত্রে নামজারি, হস্তান্তর (বিক্রয়, দান, হেবা বা বণ্টন) দলিল সম্পাদন বা বাতিল, আমমোক্তার দলিল সম্পাদন বা বাতিল এবং ঋণ গ্রহণের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের বিদ্যমান প্রথা বাতিল করা হলো। এ প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে উপরিউক্ত কার্যক্রমের জন্য তফশিলে বর্ণিত আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের আর প্রয়োজন হবে না। তবে লিজ দলিলের অন্যান্য শর্ত যেমন: কোনো প্লটের বিভাজন বা একাধিক প্লটের একত্রীকরণের মাধ্যমে প্লটের আয়তনের পরিবর্তন এবং প্লট বা ফ্ল্যাটের ব্যবহার শ্রেণির পরিবর্তন অর্থাৎ মাস্টার প্ল্যানের কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণের বর্তমান পদ্ধতি বহাল থাকবে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, দলিলগ্রহীতাকে উন্নয়নকৃত ফ্ল্যাট বা ভবনসহ ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের দুই শতাংশ হারে এবং শুধু প্লট বা ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের তিন শতাংশ হারে অর্থ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন দলিল সম্পাদনকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুকূলে জমা প্রদান করতে হবে। এছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক উন্নয়নকৃত প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে একই হারে ও পদ্ধতিতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কোডের অনুকূলে আদায় করা হবে।

এতে বলা হয় যে, লিজকৃত সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত বিরোধ পরিহার এবং মালিকানা রেকর্ড লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ ও হালনাগাদ রাখার লক্ষ্যে প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল সম্পাদনের পর অবিকল নকলের সার্টিফাইড কপি এবং নামজারির পর এ সম্পর্কিত রেকর্ডপত্র ক্রেতা বা ক্ষেত্রমতে দলিলগ্রহীতা কর্তৃক দলিল সম্পাদনের ৯০ দিনের মধ্যে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে দাখিল করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিল করতে ব্যর্থ হলে দৈনিক ৫০ টাকা হারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা যাবে। হস্তান্তর দলিল বা নামজারি সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে দাখিলের ৩০ দিনের মধ্যে মালিকানা রেকর্ড হালনাগাদ করতে হবে। হালনাগাদকৃত রেকর্ডপত্র রেজিস্ট্রার্ড ডাকের পাশাপাশি ইমেইল বা ইলেকট্রনিক অন্য কোনো মাধ্যমে ক্রেতা বা ক্ষেত্রমতে দলিলগ্রহীতাকে অবহিত করতে হবে, অথবা পাঠাতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকর্মচারীর বিরুদ্ধে কর্তব্যকর্মে অবহেলার দায়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয় যে, লিজ দলিলের মেয়াদ শেষে (নিরানব্বই বছর পর) তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নকৃত বলে গণ্য হবে এবং অনুচ্ছেদ ()-এ বর্ণিত হস্তান্তর ফি আদায়ও রহিত হয়ে যাবে। তবে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের পূর্বানুমতি ব্যতীত প্লটের বিভাজন বা একাধিক প্লটের একত্রীকরণ, প্লট বা ফ্ল্যাটের ব্যবহার শ্রেণির পরিবর্তনসহ মাস্টার প্ল্যানের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।

এতে বলা হয় যে, আবাসিক ব্যতীত অন্যান্য (প্রাতিষ্ঠানিক, বাণিজ্য ও শিল্প) প্লট, ফ্ল্যাট বা স্পেসের হস্তান্তর ও নামজারিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে লিজদাতা কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন গ্রহণের বিদ্যমান প্রথা বহাল থাকবে।

যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে মালিকানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে এবং ওই বিরোধে সরকারের স্বার্থের সংশ্লেষ রয়েছে, যেসব প্লট, ফ্ল্যাট বা বাড়ি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে অথচ ১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চের পর পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত করা হয়নি এবং যেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাট জানুয়ারি ২০০৯ থেকে জুলাই ২০২৪ মেয়াদে বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেসব প্লট, ফ্ল্যাট বা বাড়ির ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন গ্রহণের বিদ্যমান প্রথা বহাল থাকবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয় যে, আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান বা হেবা সূত্রে নামজারি, হস্তান্তর (বিক্রয়, দান, হেবা বা বণ্টন) দলিল সম্পাদন বা বাতিল, আমমোক্তার দলিল সম্পাদন বা বাতিল এবং ঋণ গ্রহণের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজন হবে না, সেসব আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাটের তালিকা এ প্রজ্ঞাপনের অধীন, যথাশীঘ্রই সম্ভব তফশিল আকারে প্রকাশ করা হবে। তবে প্রকাশিত তফশিলে পরবর্তী সময়ে কোনো ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা সংশোধনের ক্ষমতা কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানামুখী অনিয়ম এবং দুর্নীতির অবসান ঘটবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমৃত্যু হাটহাজারীবাসীর পাশেই থাকবো ইনশাআল্লাহ
পরবর্তী নিবন্ধঢাকা ও করাচির উৎসবে ‘নয়া মানুষ’