নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দেশের স্বার্থের ক্ষতি করে কাউকে বন্দর অপারেশন করতে দেওয়া হবে না। এপিএম টার্মিনাল নিয়ে গতকাল (রোববার) আমাদের সঙ্গে বৈঠক ছিল। কিন্তু তাদের দাবিগুলো আমরা মানতে পারিনি বলে তারা চলে গেছে। আমি বলেছি, তারা চলে গেলে চলে যাক। আমি দেশের ক্ষতি করে, বন্দরের আয়ের ক্ষতি করে এপিএম টার্মিনালকে কেন, কাউকেই দিতে পারবো না। গতকাল সকালে নগরীর পতেঙ্গায় লালদিয়ার চর কন্টেনার ইয়ার্ড উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নুরুন্নাহার চৌধুরী, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জমানসহ বন্দর কর্তৃপক্ষের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরো বলেন, বন্দর নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু উন্নতি করতে হলে প্রযুক্তি, অর্থ ও দক্ষতা প্রয়োজন। বন্দর ঘিরে চার পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বেশিরভাগ বন্দর বেসরকারি অপারেটররা পরিচালনা করে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? তাই আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। ব্যবসায়ীরা যেন সুযোগ পায়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।
আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়া অপারেটর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, এই অভিযোগ ঠিক না। ডিউ প্রসেস বলে একটা কথা আছে। যদি আমরা প্রসেস অনুসরণ না করতাম তাহলে আরও আগেই দিয়ে দিতে পারতাম। আগের অপারেটরের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরপরই দিয়ে দিতে পারতাম। এত সময়ের প্রয়োজন লাগতো না। আমরা কোন প্রক্রিয়ায় অপারেটর নিয়োগ দিব সব আপনারা জানতে পারবেন। যেহেতু এখন পর্যন্ত আমরা সব কাজ করতে পারি নাই। চূড়ান্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি, তাই এখন আপনাদেরকে সবকিছু বলতে পারছি না। কোনো কিছুই অপ্রকাশ্য থাকবে না। তথ্য গোপন করে আমাদের কি লাভ। তারা আমার চাচা, না মামা, নাকি আমার সেখানে বাড়ি ঘর আছে। আমার ঘর বাড়ি এই দেশে, আত্মীয় স্বজন এই দেশে। আমি মারা যাব এই দেশে। যারা কথা বলেন, তাদের যদি আমি বলি যে, গত ১৭ বছর কথা বলেননি কেন? গত ১৭ বছরে এই বন্দরে যখন লুটপাট চলছিল, তখন তো কথা বলেননি। আই অ্যাম সরি, আমি জানি আমার ওপর অনেক ইট–পাটকেল নিক্ষেপ হবে, বাট আই ডোন্ট কেয়ার।
তিনি আরও বলেন, আপনি কোনোকিছু করলেই খালি চলে গেল, চলে গেল, চলে গেল, আরে কী চলে গেল রে ভাই। আমি তো এখন মুখ ফুটে অনেক কথা বলতে পারছি না। যখন একমাথা থেকে আরেক মাথা দেওয়ার ব্যবস্থা করছিল, তখন তো কোনো কথা বলেননি। তখন তো বলেননি, চলে গেল, চলে গেল। কিচ্ছু চলে যায়নি। অনলি পোর্টের অ্যাফিশিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাতে আসি, আমি কিন্তু ‘যদি’ বলছি, যদি আমাদের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন ফুলফিল হয়, যদি আমরা দেই, তাহলে আপনারাই দেখবেন। আমি জানি না আল্লাহ কদ্দিন আমার হায়াত রেখেছেন, আপনারাই দেখবেন, এই পোর্টের চেহারা বদলেছে কী বদলায়নি।
নৌ পরিবহন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের একবিংশ শতাব্দিতে থাকতে হবে, আবার একবিংশ শতাব্দি থেকে বেরও হয়ে যেতে হবে। একসময় তো আমরা মোবাইল টেলিফোন দেখিনি। এখন মোবাইল টেলিফোন আছে। আজকাল আবার মোবাইল টেলিফোনের বাইরে গিয়ে দেখছি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই)। চীনে আমি একটা পোর্ট দেখে আসছি, যেখানে পাঁচজন লোক পোর্ট চালাচ্ছে, অনলি ফাইভ। যদি আপনাদের কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে আমি বলব যে উনি (বন্দর চেয়ারম্যান) দুই–তিনজনকে ওখানে পাঠাক, তারা গিয়ে দেখে আসুক। আমি ওখানে ঢুকে মনে হলো যে আমি একটা গোস্ট ছবি দেখছি। কোনো মানুষ নাই, জন নাই তৈরি হচ্ছে–যাচ্ছে আর বের হয়ে যাচ্ছে। আবার সামনে বাধা পাচ্ছে, সরে যাচ্ছে। আমরা এই প্রযুক্তির মধ্যে থাকব নাকি এই প্রযুক্তির মধ্যে থাকব না?
বন্দরে যানবাহনের ই–গেইট পাস সেবা চালুর প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এখন ই–গেইট সিস্টেম চালু করার কারণে প্রতিটি ট্রাক দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে গেটপাস ক্লিয়ার করে চলে যেতে পারছে। এটি শুধু বন্দরের জন্য নয়, এটি বড় ধরনের সাফল্য বন্দর পরিচালনার জন্য। যারা ব্যবসা বাণিজ্য করেন তাদের জন্যও সাফল্য, কারণ আগে গেইটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাকগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সেখানে এখন দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে কাজ সারতে পারছে। এ ধরনের উন্নতি করতে গেলে প্রযুক্তির প্রয়োজন আছে, টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে প্রযুক্তি আনার জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে বড় বড় সেক্টরে বিনিয়োগ কম হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে সমপ্রসারণ হচ্ছে, এখানে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমরা যদি এটা উপলব্ধি না করি, আমরা যদি ছোট ছোট নিজের স্বার্থ অথবা অন্যের স্বার্থ নিয়ে কথা বলি।
ট্যারিফ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ট্যারিফ নিয়ে আমি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে এখন আর বৈঠক হচ্ছে না। কারণ আদালত এক মাসের স্থগিত আদেশ দিয়েছে। এই স্থগিতাদেশের মধ্যে আমি এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না।
লালদিয়ার চর কন্টেনার ইয়ার্ড উদ্বোধন শেষে বে টার্মিনাল এলাকার পরিবহন টার্মিনাল উদ্বোধন করেন নৌ পরিবহন উপদেষ্টা। সেখানে তিনি পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু পরিবহন টার্মিনাল নয়, সব জায়গাতেই চাঁদাবাজি হচ্ছে। কারা করছে নাম বলতে পারব না। আমরা তো অনুসন্ধান করি না, অনুসন্ধান করেন সাংবাদিকরাই। তবে এখানে (বে–টার্মিনাল এলাকায় পরিবহন টার্মিনাল) কেউ এসবের (চাঁদাবাজি) সুযোগ পাবে না। বরং পরিবহন খাতের গাড়িগুলো যখন এখানে আসবে, শহরের যানজট অনেকটা কমে যাবে। পরে তিনি তালতলা কন্টেনার ইয়ার্ড উদ্বোধন, এঙওয়াই শেড পরিদর্শন এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস অকশন শেড পরিদর্শন করেন। কাস্টমস অকশন শেড পরিদর্শনকালে তিনি কাস্টমস কর্মকর্তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে অকশন শেডে থাকা নিলামযোগ্য পণ্য নিলাম দিয়ে অকশন শেড খালি করার নির্দেশনা দেন।












