অধ্যাপক সুনীতি ভূষণ কানুনগো ও তাঁর ইতিহাসচর্চা

কানিজ ফাতেমা | সোমবার , ১০ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো ছিলেন ইতিহাসের জন্য নিবেদিত প্রাণ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ও নিভৃতচারী গবেষক। ব্যক্তিজীবনে প্রচারবিমুখ এই সাধক ইতিহাস গবেষণায়-চর্চায়-সাধনায় প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়েছেন। বই তাঁর সব সময়ের বাহন। বই লিখেছেন তাও আবার নিজ খরচে প্রকাশ করেছেন। বাইরের বিরূপ পরিবেশ ও রূঢ় প্রতিবন্ধকতা কখনো তাঁর লেখালেখিতে গতিরোধক হিসেবে কাজ করেনি। কানুনগো স্যারের অজস্র মৌলিক গ্রন্থরাজি ইতিহাসের আকর হয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান সৃজন, জ্ঞান বিতরণ ও গ্রন্থ লেখনীর মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগকে সমৃদ্ধ করেছেন তা নয়, প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে। পিতা পুলিন বিহারী কানুনগো যিনি কানুনগোপাড়া ড. বি. বি. উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং মাতা সুচারু প্রভা কানুনগো। বাবা-মায়ের স্নেহ ও তত্ত্বাবধানেই শিক্ষিত পারিবারিক ঐতিহ্যে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছে। ড. সুনীতির একমাত্র ছোট ভাই সুকৃতি ভূষণ কানুনগো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে পিএইচডি সম্পন্ন করে রসায়ন বিজ্ঞানী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে কর্মরত। অধ্যাপক সুনীতির সহধর্মিণী লীনা কানুনগো সরকারি সিটি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম বেতারের নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে দু‘সন্তানের জনক। তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র পার্থ সারথি কানুনগো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। জীবনসঙ্গিনী মিসেস কানুনগো পুত্র শোকের ব্যথা নিয়ে ২০১৯ সালেই প্রয়াত হয়েছেন। কনিষ্ঠ পুত্র দীপঙ্কর কানুনগো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স থেকে এমএসসি পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সেখানেই থিতু হয়েছেন। উপমহাদেশের স্বনামধন্য ঐতিহাসিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো ছিলেন সুনীতি স্যারের জ্যাঠামণি।

সুনীতি ভূষণ কানুনগোপাড়া ড. বিভূতিভূষণ দত্ত উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতা সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। উক্ত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের এম.এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে এম.এ সম্পন্ন করে কানুনগোপাড়ায় ফিরে আসেন এবং ১৯৬১ সালে বিখ্যাত স্যার আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনায় যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনের সূচনা। জ্যাঠামনি ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগোর নির্দেশনায় তাঁরই ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল হালিমের অধীনে ১৯৬৩ সালে সুনীতি পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘ A History of Chittagong under Muslim Rule ’ এ সময় উপমহাদেশের আরেক প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. আবদুল করিম লন্ডন থেকে দ্বিতীয় পিএইচডি শেষ করে সদ্য দেশে ফিরেন। সুনীতি কানুনগোর মেধা ও প্রজ্ঞা অনুধাবন করে ড. করিম তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেন। ১৯৬৪ সালের জুন থেকে ১৯৬৫ সালের জুন পর্যন্ত সুনীতি স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র এক বছর শিক্ষকতা করে আবার স্যার আশুতোষ কলেজে ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেন।

ইতোমধ্যে অধ্যাপক আবদুল হালিম পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। তিনি তখন ইতিহাসের আরেক দিকপাল অধ্যাপক আহমদ হাসান দানী’র সাথে দেখা করে গবেষণার ইচ্ছে প্রকাশ করলে ড. দানী জানান, ‘তোমার চট্টগ্রাম বিষয়ে আমার তেমন কোন পরিস্কার ধারণা নেই, তুমি আমার ছাত্র আবদুল করিমের সাথে যোগাযোগ করতে পার।’ ১৯৬৬ সালে ড. আবদুল করিম সদ্য প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলে পরবর্তীতে প্রিয় শিষ্য কানুনগো তাঁর অধীনে থিসিসের বাকী কাজ শেষ করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে পিএইচডির কাজ শেষ হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিভিন্ন কারণে কানুনগো স্যারের ডিগ্রি অর্জিত হয় ১৯৭৩ সালে। সুনীতি ভূষণ কানুনগো ড. করিমের তত্ত্বাবধানে যেমন প্রথম পিএইচডি গবেষক, তেমনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। ১৯৭৫ সালে উপাচার্য ড. করিম তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে ড. কানুনগোর নতুন কর্মজীবন শুরু হয়। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন লোক প্রশাসন ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ ২৪ বৎসর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ১৯৯৯ সালের অবসর গ্রহণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গবেষণাকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। জীবনের সঞ্চিত অর্থ এবং পেনশনসহ প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নিজ গ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য পাকা দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে যেতে পারেননি।

ইতিহাসবিদ-গবেষক অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো মূলত বর্ণনামূলক ইতিহাসচর্চা করে গেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ছিল স্যারের সবচেয়ে প্রিয় স্থান। প্রায় আশিরও বেশি বয়স পর্যন্ত তিনি নিয়মিত লাইব্রেরিতে যেতেন। এরই ফলস্বরূপ বই লিখেছেন ২০টিরও বেশি। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় বাংলার রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কথা, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের মতো জটিল বিষয় সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের উপযোগী সর্বাধিক ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা।

অধ্যাপক সুনীতি ভূষণ কানুনগোর A History of Chittagong (Vol. I) গ্রন্থটি হলো চট্টগ্রামের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে রচিত যা ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর পিএইচডি থিসিসের ভিত্তিতেই রচিত। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যুক্তরাজ্য নিবাসী Paola Tinti eBwU covi ci Vol. II এর খোঁজে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গী বাজারে কানুনগোর ভাড়া বাসায় ছুটে আসেন। তাঁর A History of Chittagong (Vol.II) গ্রন্থটি চট্টগ্রামের আধুনিক যুগের (১৭৬১-১৯৪৭) ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে যা ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দুটিতে ড. কানুনগো চট্টগ্রামের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং এর ঘটনাবলী নিয়ে অধ্যাপক কানুনগোর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে The Chittagong Revolt 1930-34”| । ‘ইংলন্ডের ইতিহাস’ গ্রন্থে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক দিক মুখ্য বিষয়বস্তু হলেও শাসনতান্ত্রিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাহিত্য নিয়েও স্যার আলোচনা করেছেন। এছাড়া ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম’; ‘ A History of the Chittagong Hill Tracts ‘বাংলায় ভক্তিবাদ, ‘চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।

কানুনগো স্যার চাকমা জাতির আত্মপরিচয়, তাদের ভূমি অধিকার এবং ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চাকমাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধের সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন ‘ Chakma Resistance to British Domination গ্রন্থটি। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলায় কলুষিত ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে বৈষ্ণব আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি রচনা করেন ‘বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলন’ গ্রন্থ। ‘প্রাচ্যের রাষ্ট্র দর্শন’ গ্রন্থে ড. কানুনগো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজ্যগুলির ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করেছেন।

অধ্যাপক কানুনগো চট্টগ্রামের মধ্যাঞ্চল তথা কর্ণফুলী নদী ও শংখনদের মধ্যবর্তী ভূভাগ নিয়ে রচনা করেন ‘প্রাচীন হরিকেল রাজ্য ও মধ্য চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ। মধ্য চট্টগ্রামের একটি বিশেষত্ব হলো এখানেই প্রাচীনকালে হরিকেল নামে একটি স্বাধীন রাজ্যর উদ্ভব হয়ে প্রায় পাঁচশত বছর পর্যন্ত টিকেছিল। গ্রন্থটি মধ্য চট্টগ্রাম নিয়ে রচিত হলেও লেখক বৃহত্তর চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেননি।

ইতিহাসের সকল গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণ্য উপকরণ গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে কানুনগো স্যার রচনা করেন ‘বাংলার ইতিহাস’(৩ খণ্ড)। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন নিয়ে নিয়ে রচনা করেছেন ‘বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস’ (১ম ও ২য় খণ্ড)। তিনি প্রথম খণ্ডে বাংলার প্রাচীন যুগের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো বিশদভাবে আলোচনা করেছেন এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলার মধ্যযুগকে সুলতানী আমল ও মোগল আমলে ভাগ করেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে দুই আমলের শাসনব্যবস্থার নিজস্বতা ফুঁটিয়ে তোলা। বাংলা ছিল সুলতানী আমলে স্বাধীন এবং নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আর মোগল আমলে বাংলা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল এবং মোগল প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও উভয় আমলেই যে শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল লেখক তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন এই গ্রন্থে। বহু ইতিহাসবিদের মতে, বাংলার ইতিহাস (৩ খণ্ড) এবং বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস (দুই খণ্ড) অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস নিয়ে রচিত সব থেকে সমৃদ্ধ এবং নির্ভুল ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলে পরিচিত।

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁস ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গৌরবময় ঘটনা। এটি বাংলার অগ্রসরতার নব দিক উন্মোচন করেছে। বাংলার রেনেসাঁসের প্রেক্ষাপট ও প্রভাব নিয়ে ২০২৪ সালে স্যারের সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘বাংলায় রেনেসাঁস আন্দোলন’। এছাড়া ‘কালিকারঞ্জন কানুনগো : জীবন ও কর্ম’; ‘মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী : জীবন ও কর্ম’; ‘শরচ্চন্দ্র দাশ : জীবন ও কর্ম’; ‘নবীনচন্দ্র দাশ : জীবন ও কাব্যচর্চা’; ‘চট্টগ্রাম চরিতাভিধান’ জীবনচরিত রচনা করেন। তিনি এই গ্রন্থগুলোতে সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে জীবন চরিতের ঘটনাসমূহ যথাসম্ভব সঠিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আত্মকথা’সহ ‘পটিয়ার ইতিহাস’; ‘চট্টগ্রামে রেনেসাঁস আন্দোলনে মুসলমান সমাজের ভূমিকা’ প্রভৃতি অপ্রকাশিত থেকে যায়।

ড. কানুনগো সারাজীবন ব্যস্ততম নগরীর আলো ঝলমল পরিবেশে বাস করে শেষ জীবনে বেছে নিয়েছেন স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক ভিটা কানুনগোপাড়ার গ্রামীণ সেই কাদামাখা পরিবেশ যেথায় কেটেছে তাঁর দুরন্ত শৈশব। গত ২৪ আগষ্ট ২০২৫ পেনশন সংক্রান্ত কাজে পিসতুতো ভাই দোলন কানুনগোর সহযোগিতায় তিনি শেষবারের মতো প্রিয় কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। এরই সুবাদে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের শহীদ হূদয় চন্দ্র তরুয়া ভবন প্রাঙ্গনে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রিয় শিক্ষাগুরুকে এক পলক দেখার জন্য সমবেত হয়। সেখানে দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। বার্ধক্যের অচলাবস্থার কারণে গাড়িতেই বসেছিলেন কানুনগো স্যার। শিশুসুলভ চাহনীতে কুশল বিনিময় করলেও স্মৃতিশক্তি তখনও ছিল প্রখর। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘তোমাদের সাথে আরো কিছুটা সময় থাকতে পারলে ভালো লাগতো’। প্রত্যুত্তরে বললাম, আপনি আমাদের জন্য সুস্বাস্থ্যে শতায়ু হোন এবং আরো গবেষণাধর্মী লেখা উপহার দিন।’ স্যার অস্পষ্ট স্বরে বলেই ফেললেন, ‘আর বাঁচিবার শখ নেই।’ হয়তো তাঁর জানা হয়েছিল মৃত্যু সন্নিকটে। নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর। এটাই ছিল কানুনগো স্যারের সাথে শেষ দেখা; শেষ কথোপকথন ও শেষ স্মৃতি।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় অধ্যাপক সুনীতি ভূষণ কানুনগোর প্রবন্ধ গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘চট্টগ্রাম একাডেমি শিল্পশৈলী’ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ প্রদান করেছে। তাঁর কর্মের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মানিত হওয়ার যাবতীয় গুণাবলী থাকার পরও তিনি জাতীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি পাননি। ৪ অক্টোবর ২০২৫ শনিবার বিকাল ৪ টায় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়ার বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শ্রদ্ধেয় কানুনগো স্যার প্রয়াত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষকদের জন্য পরতে পরতে রেখে গিয়েছেন সহজ সাবলীল ভাষায় তাঁর লিখিত এক একটি মূল্যবান মৌলিক আকর গ্রন্থ। ব্যক্তিজীবনে প্রচারবিমুখ এই গুণী শিক্ষককে তাঁর শত-সহস্র শিক্ষার্থী ও গবেষক স্মরণীয় করে রাখবে, তাঁর রচনাবলী তাঁকে অমরত্ব দান করবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিশোর অপরাধ : উদ্বেগের বিষয়
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃত স্বায়ত্তশাসিত সিটি গভর্নমেন্ট ছাড়া জনগণকে মানসম্পন্ন সেবা প্রদান অসম্ভব