সুদান – কেন এই ভ্রাতৃঘাতি গণহত্যা?
আফ্রিকার দেশ সুদান। সুদানের দক্ষিণ পশ্চিমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, পশ্চিমে চাদ, উত্তর পশ্চিমে লিবিয়া, উত্তরে মিশর. পূর্বে লোহিত সাগর আর ইরিত্রিয়া, দক্ষিণ পশ্চিমে ইথওপিয়া। পাঁচ কোটির কিছু অধিক সংখ্যক মানুষের বাস এই সুদানে। জনসংখ্যার সাতান্নব্বই শতাংশেরও অধিক সুন্নী মুসলিম। সুদানের আয়তন ৭২৮,২১৫ (সাত লক্ষ আটাশ হাজার দুইশত পনের) বর্গ মাইল। আয়তনের দিক থেকে সুদান আফ্রিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ।
মধ্যপ্রাচ্য তথা এশীয় গাজার অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞের প্রবল তাণ্ডবে বিশ্ববাসী এখন বিমর্ষ বিমূঢ়। ইউরোপিয় ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রবল আক্রমণে সমস্ত ইউরোপ–আমেরিকা ছন্নছাড়া, দিশেহারা আমেরিকা ইউক্রেনকে বাঁচানোর পথ খুঁজতে গিয়ে এখন বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের মুখামুখি ঠেলে দিচ্ছে। এমন এক পটভূমিতে আফ্রিকার সুদান এখন গণহত্যার এক বিপন্ন বিষাদ বিস্তৃত ভূমিতে রূপান্তরিত। বাস্তবে সুদান চরম দারিদ্র পীড়িত একটি দেশ। খরা, দুর্ভিক্ষ মহামারী ইত্যাদি সুদানের নিত্য সঙ্গী।
এমন এক হতভাগ্য দেশে গত ১৫ এপ্রিল ২০২৩ থেকে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিবাদমান গোষ্ঠী সমূহের মধ্যে হন্তারক সময় পাড় করার তীব্র এক প্রতিযোগিতা চলমান। এ প্রবণতা থেকে সুদানে গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। যুদ্ধের দাবানল এখন সুদানকে গ্রাস করে চলেছে প্রতিনিয়ত। অতীতেও সুদান গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তবে এবারের গৃহযুদ্ধ পুরাপুরি বিবাদমান সামরিক বাহিনী গুলি দ্বারা সৃষ্ট পরে এতে ইন্ধন যোগানোতে যুক্ত হয়েছে বাইরের স্বার্থান্বেষী মহল তথা বহিঃশক্তি।
সুদানের চলমান সংঘাত, এটি এমন নয় যে দুটি দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, এটি এমন নয় যে কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠায় এই গৃহযুদ্ধ চলছে, এটি এমন নয় যে ধর্মীয় কোন উগ্রগোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর উপর আদিপত্য বিস্তারে এটি শুরু করেছে। এটি শুরু হয়েছে সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিছক আধিপত্য বিস্তার বা আধিপত্য ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা থেকে।
১৯৮৯ সালে ফিল্ড মার্শাল আবদেল রহমানের তথাকথিত নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল ওমর আল বশির সুদানের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেই থেকে ১১ এপ্রিল ২০১৯ আরেক সামরিক অভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যূত না হওয়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর জেনারেল ওমর আল বশির সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন।
২০১৯ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল আউয়াদ ইবনে আউফ ক্ষমতা দখল করলেও পরদিন জেনারেল আবদেল ফাতেহ আল বুরহানের পক্ষে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। সেই থেকে জেনারেল বুরহান সুদানে ক্ষমতাসীন।
জেনারেল আবদেল ফাতেহ আল বুরহানের ক্ষমতাদখলের পরপর গঠিত কাউন্সিলে বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও অংশ গ্রহণ ছিল। এক সময় সেই কাউন্সিল থেকে বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বের করে দিয়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা একছত্র করার জন্য জেনারেল আবদেল ফাতেহ আল বুরহান এবং জেনারেল হামদান নাগালো’ গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। কিন্ত্তু ক্ষমতা এমনিই এক মোহ মন্ত্র যা তাদের আর এক থাকতে দেয়নি।
১৫ এপ্রিল ২০২৩ সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দেয় এবং সুদানে শুরু হয় আরো একটি দুর্ভাগ্যজনক গৃহযুদ্ধ, এ থেকে উৎসারিত গণহত্যা। এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যখন জেনারেল হামদান নাগালো’র নেতৃত্বাধীন আর এস এফ (র্যাপিট সাপোর্ট ফোর্স) ’কে এস এ এফ (সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস) এর সাথে আত্মীকরণের প্রস্তাব করা হয়।
জেনারেল হামদান নাগালো’র নেতৃত্বাধীন আর এস এফ’ সুদানের মূল সেনাবাহিনীতে একিভূত হওয়ায় অস্বীকৃতির মাধ্যমে এবং বিদ্রোহে সুদান ক্রমাগত হত্যা ধ্বংস বাস্ত্তুচ্যূতির অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি দাঁড়ায়। মূলত সামরিক পক্ষগুলির যুদ্ধের মাঝে পড়ে চরম দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হয় সুদানের দারিদ্র পীড়িত অসহায় মানুষগুলি। বিভিন্ন পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে যে চিত্র তুলে ধরে তা যেমন হৃদয় বিদারক তেমনি মর্মান্তিকও।
যেমন এ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যশনালের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১৫০০০০ (দেড় লক্ষ) এর অধিক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন। বাস্ত্তুচ্যুত হয়েছেন ১৫০০০০০০ (দেড় কোটি)’র উপর মানুষ। দুর্ভিক্ষ জেকে বসেছে পুরা সুদান জুড়ে। দুর্ভিক্ষের শিকারে যত্রতত্র মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। জাতিসংঘ সুদানের এ অবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসাবে আখ্যায়িত করেছে।
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিকের “আল ফাসার” শহরের ঘটনা শুধু হৃদয় বিদারক নয় ভয়াবহও। দারফুর অঞ্চলের এই শহরটি দীর্ঘ আঠার মাস ধরে বিদ্রোহী জেনারেল হামদান নাগালো’র নেতৃত্বাধীন আর এস এফ’ অবরোধ সৃষ্টি করে রেখেছিল। এই অবরোধ “আল ফাসার” শহরের এস এ এফ (সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস)’ কে ঐ অঞ্চলে দারুণ বেকায়দায় ফেলে।
বিগত ২৬ এবং ২৯ অক্টোবর ২০২৫ এর মাঝে পশ্চিম সুদানের দক্ষিন দারফুর এর রাজধানী আল ফাসার আক্রমণ করে এবং দীর্ঘ অবরোধের সুযোগে আর এস এফ’ “আল ফাসার” শহরের এস এ এফ কে পরাস্ত করে আল ফাসারের দখল নিয়ে নেয়। এর পরই আল ফাসারে আর এস এফ তার প্রতিহিংসামূলক আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে।
ইতিমধ্যে আর এস এফ এর আক্রমণে ২৬০,০০০ (দুই লক্ষ ষাট হাজার) অধিবাসীর শহর আল ফাসার এর ৬৫০০০ (পঁয়ষট্টি হাজার) মানুষ জীবন নিয়ে পালিয়েছে অন্যত্র আশ্রয়ের সন্ধানে। বাকীদের অনেকেই ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন অথবা শিকারে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। এম এস এফ বা ডক্টর উইদাউট বর্ডার আল ফাসার’এর এ অবস্থাকে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা বলে অভিহিত করেছেন।
ইয়েল ইউনিভার্সিটি’র মানবাধিকার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন, বড় সংখ্যক তেমন কোন দল আল ফাসার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা তারা পর্যবেক্ষণ করেনি। এর কারণ হয়ত পলায়নরত মানুষেরা আটক হয়েছেন অথবা হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইয়েল ইউনিভার্সিটি’র পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন তারা আল ফাসার’এর আশে পাশে ৩১ টি মানব দেহের স্তূপ পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সম্ভবত এসব মানবস্ত্তূপ নিহতদের জড়ো করার আলামত। এখন প্রশ্ন এসেছে সুদানের এ গৃহ যুদ্ধের শুরু ত সামরিক বাহিনী এবং প্যারমিলিটারী বাহিনীর একিভূতকরণ নিয়ে এর পর, এখন এর পিছনে মদদ দাতা কে বা কারা? এবং এতে মদদ দাতাদের স্বার্থ কী?
এ প্রশ্নের উত্তরে যে দেশের নামটি প্রথম আসছে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে সুদানের প্রতিনিধি উচ্চারণ করেছেন সেটি হল ইউ এ ই (ইউনাইটেড আরব আমিরাত) । ইউ এ ই’র সুদানে স্বার্থ কী? স্বার্থ হল দারফুর’এর স্বর্ণ খনি। দ্বিতীয় দেশ হিসাবে যে দেশের নাম উচ্চারিত হচ্ছে সেটি হল ফ্রান্স।
ফ্রান্সের নাম আসার পিছনে কারণ হল ফ্রান্স ইউ এ ই’র কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। ইউ এ ই আর এস এফ’কে মদদ যোগাচ্ছে। আর তাই ফ্্রান্স ক্রয়কৃত এই অস্ত্র ইউ এ ই’র কাছ থেকে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে আর এস এফ এর কাছে। পর্যবেক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী এ র্পযন্ত ফ্রান্স ইউ এ ই’র কাছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে, বলাবাহুল্য ইউ এ ই’ এ অস্ত্র নানা মাধ্যমে পৌঁছে দেয় এস এফ এর কাছে। উল্লেখ্য এই আর এস এফ’কে ভারাটে বাহিনী হিসাবে ইউ এ ই ইয়ামেনীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল এবং ইয়েমেনে গণহত্যার জন্য এই বাহিনী অনেকাংশে দায়ী।
এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে একটি ঘটনা তুলে ধরছি, ২০২২ সালের দিকে ইয়েমেন যুদ্ধ যখন তুঙ্গে আমি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের স্ট্রেটেজিক পার্টনার বিষয়ক এক আলোচনার্থে ইউ এ ই সফর করছিলাম। প্রতিদিন আমার হোটেল কক্ষ থেকে জানালা খুলে আশপাশ দেখতাম। আমি লক্ষ্য করে দেখি হোটেলে থাকা ইউ এ ই’র পতাকা প্রতিদিন অর্ধনমিত। এটি পরপর তিনদিন আমার দৃষ্টি গোচর হয়। বিষয়টি হোটেল অভ্যর্থনায় গিয়ে জানতে চাইলে তারা জানায় ইয়েমেনে প্রতিদিন ইউ এ ই’র সৈন্য নিহত হচ্ছে তাই পতাকাও প্রতিদিনই অর্ধনমিত থাকছে। এবিষয়টি আমি ইউ এ ই’র অত্যন্ত দায়িত্বশীল এক কর্তা ব্যক্তির সামনে তুলে ধরলে তিনি নিরুত্তোর থাকেন।
আল ফাসার’এর বর্তমান পরিস্থিতি সচেতন মহলকে ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বা বিশ বছর আগের দারফুরের গণহত্যা।
সুদানের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকেই ধাবিত হবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। এই অবনতিশীল পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য অবশ্যম্ভাবী আরো আরো দুর্ভোগ, দুর্ভিক্ষ এবং মৃত্যু ডেকে আনবে। পরিণামে সুদানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ক্রমান্বয়ে হুমকির মুখামুখি হবে।
সব দেখে শুনে এখন মনে হয় বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সুদানের গৃহযুদ্ধ এখন একটি ভুলে যাওয়া অধ্যায়। আর সুদানের গৃহ যুদ্ধে লিপ্তদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে ক্ষমতাই মুখ্য। আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহল যারা সুদানের গৃহযুদ্ধে ইন্ধন যোগাচ্ছেন তাদের কাছে মানবিকতা নয় বরং সাধারণ মানুষের রক্তের হোলি খেলায় মেতে সম্পদের পাহাড় গড়াই লক্ষ্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।












