নাগালের বাইরে ইলিশের দাম

কমেছে আহরণ, মুনাফা লুটে খাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা

শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | শনিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

যদিও দীর্ঘকাল ধরে ঊর্ধ্বমুখী ইলিশের দাম। এর মধ্যে ২০২০ সালের আগে অনেকটা কম ছিল দাম। তখন ৫০০গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিতে বিক্রি হয়েছিল ৪০০৫০০ টাকায়। কিন্তু সেই ৫০০ গ্রাম ইলিশের দাম এখন ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা!

পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ও চলতি বছর দাম অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বর্তমানে এক কেজি ইলিশ তিন হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে!

জেলেরা বলছেন, সমপ্রতি বছরগুলোতে ইলিশ আহরণ অনেক কমে এসেছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার মৎস্য আহরণ বন্ধ, জাটকা নিধনসহ নানা উদ্যোগ নিলেও ইলিশের উৎপাদন বাড়েনি, বরং কমেছে! মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩২৪ অর্থবছরে দেশের জেলেরা ৫.২৯ লাখ টন ইলিশ আহরণ করেছেন। ২০২২২৩ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৫.৭১ লাখ টন। চাহিদার তুলনায় কম আহরণে ইলিশের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ইলিশের দাম বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে ‘হাতবদল’। জেলে পর্যায় থেকে ব্যবসায়ীদের এক হাত থেকে অন্যহাতে কয়েক দফা ঘুরতে ঘুরতে ভোক্তা পর্যায়ে যেতে জেলে মূল্যের দিগুণ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এক নতুন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইলিশ ধরে আড়ত পর্যন্ত নিয়ে আসতে জেলেদের প্রতি কেজিতে গড়ে খরচ পড়ছে ৪৭১ থেকে ৫০৪ টাকা। আর জেলেদের কাছ থেকে এই মাছ ভোক্তার ঘরে যাচ্ছে কমপক্ষে পাঁচ হাত ঘুরে। আর প্রতি হাতে ৬০ শতাংশ করে দাম বাড়ছে। ফলে বর্তমানে প্রতি কেজি ইলিশ আকার ভেদে ৭০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ছোট, মাঝারি ও বড় নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে ইলিশ ধরা হয়। ছোট নৌকায় যারা মাছ ধরে, তাদের প্রতি কেজি ইলিশ ধরতে খরচ হয় ৪৮৪ টাকা। মাঝারি নৌকার প্রতি কেজি মাছ ধরার খরচ পড়ে ৫০৪ টাকা। আর বড় নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে প্রতি কেজি ইলিশ ধরতে খরচ হয় ৪৭১ টাকা। এই মাছ জেলের হাত থেকে প্রথমে আসে মাছঘাটের মহাজনের কাছে। এরপর যায় আড়তদারের হাতে। আড়তদার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী হয়ে আসে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। এই পাঁচ ধাপের প্রতিটিতে ৫৯৬০ শতাংশ হারে দাম বাড়ে!

ঢাকার খুচরা বাজারেও এই মূল্য বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা গেছে। ঢাকার বাজারগুলোতে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ৬০০৬৫০ টাকা কেজি, ৫০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০৮০০ টাকা কেজি। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি, ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, ১ কেজি থেকে ১.৫ কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং ১.৫ কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

জেলে ও বোট মালিকরা জানিয়েছেন, ইলিশের বেশি দামের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে যেসব দাদন ব্যবসায়ী জেলেদের পেছনে বিনিয়োগ করেন, তারা নদীর ঘাটে মাছ বিক্রির সময় সর্বনিম্ন দর ঠিক করে দেন। দাদন ব্যবসায়ীদের ঠিক করা সর্বনিম্ন দামের বেশি উঠতে পারে না আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি, মজুত ও সিন্ডিকেট এবং জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায়ও ইলিশের দাম বাড়ছে। এছাড়া জেলেদের মজুরি, ট্রলার বা নৌকার রক্ষণাবেক্ষণ, জাল মেরামত, বরফ ও অন্যান্য উপকরণের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ইলিশ আহরণের খরচ বেড়েছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুরো মৎস্য আহরণ ব্যবসা এখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। ইলিশ তো সোনার হরিণ! একদিকে মৎস্য আহরণ কমেছে অন্যদিকে খরচ বেড়েছে। এতে আহরিত মাছ দিয়ে খরচ মিটিয়ে টাকার মুখতে তেমন দেখতে পান না বোট মালিকরা। বাড়তি দামে ইলিশ বিক্রি হলেও উৎপাদন কম হওয়ায় পোষানো যায় না। কিন্তু দাদন ব্যবসায়ী ও পাইকাররা ঠিকই মুনাফা করে যাচ্ছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচন নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তারা স্বৈরাচারের দোসর : প্রেস সচিব
পরবর্তী নিবন্ধঐক্য ভাঙার কোনো সুযোগ নেই : খসরু