চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু শুরুতেই সামনে এসেছে এক অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা– চাকসুর নামে নেই কোনো ব্যাংক হিসাব বা নির্দিষ্ট তহবিল। অথচ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই খাতে আদায় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা।
চবি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাকসু ফি নেওয়া হয়, যা গড়ে বছরে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। কিন্তু দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে সংগৃহীত এই অর্থ কোথায় গেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর কেউই স্পষ্টভাবে দিতে পারছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিয়ামক মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘চাকসুর কোনো আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল হিসাবেই টাকা জমা হয়েছে। চাকসু নির্বাচন না হলেও চাকসুর কার্যালয়ের অন্যান্য কার্যক্রম তো বন্ধ ছিলো না। সেখানে নিয়মিত লোকবল ছিলো, আনুষঙ্গিক সব ধরনের খরচ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সব কাজ করা হয়েছে সেখানে ব্যয় হয়েছে। চাকসুর বাৎসরিক আয় ১২ লক্ষ টাকা। অথচ চাকসু কেন্দ্রিক বাৎসরিক যে ক্রীড়ার আয়োজন করা হয় সেখানে প্রায় ৬০ লাখের অধিক খরচ হয় যা বিশ্ববিদ্যালয় বহন করে। এখন যেহেতু নির্বাচন হয়েছে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে চাকসুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নতুনভাবে তহবিল গঠন করবে।’
এই অবস্থায় নতুন নেতৃত্বের প্রতিনিধিরা আর্থিক সংকটে পড়ে কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না। চাকসুর (ভিপি) ইব্রাহিম হোসেন রনি বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর জানতে পারি চাকসুর কোনো ফান্ড নেই। ৩৫ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হয়েছে, সেটির হিসাব প্রশাসন থেকে চাওয়া হয়েছে। উনারা আমাদেরকে কোনো হিসাব দিতে পারেননি। তবে ভিসি স্যার অর্থ নিয়ামক দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত সময়ের মধ্যে সবার উদ্দেশ্য এত বছরের একটা হিসাব দিতে। টাকাগুলো কোথায় গেল, সেটা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলে যাব।’ কখন হিসাব দিবে এমন কোনো নির্দিষ্ট সময় দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময় বলেননি তবে আমরা দুই একদিন পর আবার প্রশাসনকে নক করবো।’ সহ–সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, ‘প্রতি বছর লাখ টাকার ফি তোলা হয়েছে, অথচ এখন চাকসুর হাতে এক টাকাও নেই। আমরা শিগগিরই বাজেট তৈরি করে প্রশাসনের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করব। শিক্ষার্থীদের টাকার ব্যবহার শিক্ষার্থীদের জানার অধিকার।’
তবে শিক্ষার্থীরা মনে করেন, প্রশাসন বহু বছর ধরে ফি আদায় করলেও এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী মেহজাবিন আক্তার বলেন, ‘আমরা ভর্তি সময় চাকসু ফি দিয়েছি, কিন্তু এখন যদি চাকসুর নামে কোনো অ্যাকাউন্টই না থাকে, তাহলে টাকা গেছে কোথায় সেই জবাব প্রশাসনকেই দিতে হবে।’
বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী মাহিমুল হক বলেন, ‘৩৫ বছর পর চাকসু ফিরেছে, কিন্তু অর্থের হিসাবহীনতায় শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। টাকাগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্বাধীন অডিট দরকার।’
চাকসু নেই কিন্তু তার কার্যক্রমগুলো চলমান আছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ফাইন্যান্স কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় তখন তারা একটি ফি দেয়, সেখান থেকে চাকসু বাবদ আয় হয়। ঘটনা হচ্ছে চাকসু নেই কিন্তু চাকসুর কার্যক্রমগুলো চলমান আছে। যেমন প্রত্যেক বছর বার্ষিক খেলাধূলা হচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চা পানি খাওয়ানো হচ্ছে, ওখানে স্টাফদের পেছনে খরচ হয়েছে এবং চাকসুর অন্য যে কার্যক্রম যেমন বিভিন্ন দিবস যেগুলো হয়ত চাকসু করত। সেই খরচগুলো চাকসুর ফান্ড থেকে হয়েছে কি–না সেটি দেখতে হবে।’
উপাচার্য আরও বলেন, ‘আমার জানামতে চাকসুর কোনো ফান্ড নেই, ছিল না। তার মানে এই না যে চাকসুর খাতে কোনো আয় হয়নি। প্রত্যেক বছর ছাত্ররা ভর্তির সময় চাকসুর একটা ফি সেটা দিয়েছে। সেই টাকা খরচ হয়েছে। কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে সে হিসাব ভাইস চ্যান্সেলরের পক্ষে রাখা সম্ভব না। সেটি হিসাব অফিস জানবে। তবে তারা হিসাব দিতে পারবে বলে মনে হয় না যেহেতু ৩৫ বছর চাকসু ছিল না। তিনি আরও বলেন, নতুন করে চাকসু শুরু হয়েছে আমরা তাদের সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দিব। আমরা প্রয়োজনে চাকসুর জন্য ফান্ড চাইব ইউজিসির কাছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রে একটাই বিষয় চাকসুর নামে আদায় করা কোটি টাকার ফি আসলে কোথায় গেল? নবনির্বাচিত ছাত্রনেতারা যখন নতুন সূচনার স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তখনই পুরোনো হিসাবের এই অস্বচ্ছতা পুরো ছাত্রসংসদের ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে।












