সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি পরম করুণাময়। সালাম ও বরকত বর্ষিত হোক আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর।
আল্লাহ তায়ালার এক মর্মস্পর্শী ঘোষণা, যেখানে বলা হচ্ছে–
‘আল্লাহর নিকট তওবা গ্রহণযোগ্য তাদের জন্য, যারা অজ্ঞতার বশে পাপ করে, অতঃপর শীঘ্রই তওবা করে নেয়; আল্লাহ তাঁদের তওবা কবুল করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আন–নিসা, আয়াত ১৭)
মানুষের জীবন ভ্রান্তি ও ত্রুটিতে পরিপূর্ণ। মানুষ যতই সাধু, আলিম বা পরহেজগার হোক কখনো না কখনো ভুল করবেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর সীমাহীন রহমতে বান্দার জন্য এক অনন্য আশ্রয় তৈরি করেছেন তওবা। তওবা হচ্ছে বান্দার আল্লাহর দিকে ফিরে আসা, পাপের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাওয়ার হৃদয়স্পর্শী আবেদন। ইসলাম তওবাকে কেবল গুনাহ মাফের উপায় নয়; বরং এটি বান্দা ও রবের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সেতুবন্ধন।
এই সেতুবন্ধনের জীবন্ত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর জীবনে যিনি তওবা ও ইস্তেগফারের আধ্যাত্মিক শক্তিকে বাস্তবে উপলব্ধি করেছিলেন।
যা পর্যায়ক্রমে আমার লিখায় তুলে ধরবো। তার আগে তওবার মূল অর্থ ও কুরআনিক ব্যাখ্যা একটা ধারণা পাঠকের জন্য উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।
‘তওবা’ শব্দটি আরবি। যার অর্থ ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন। অর্থাৎ বান্দা যখন আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে এসে তাঁর আনুগত্যে প্রবেশ করে, সেটিই তওবা।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য স্থানে তওবার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। যেমন, সূরা নূরে ২৮:৩১ আয়াতে পাকে বলেছেন – ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকটে তওবা কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’
আরেক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন – ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা নিজেদের পরিশুদ্ধ রাখে তাদেরও ভালোবাসেন।’ (সূরা আল–বাকারা, ২:২২২)।
পবিত্র এই আয়াতগুলো স্পষ্ট ধারণা দেয় তওবা কেবল ক্ষমা চাওয়ার বিষয় নয়, বরং এটি আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের পথ। সে অর্জনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) এক আলোকিত ঘটনা যা আমার এ লিখার শিরোনামে প্রকাশ পেয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) এর আলোকিত ঘটনাটি ছিলো এক আধ্যাত্মিক ও হৃদয়স্পর্শী, ঘটনাটি তুলে ধরার আগে ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) এর সংঙ্কিপ্ত পরিচয় উপস্থাপন করলাম।
ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) (জন্ম: ১৬৪ হিজরি / মৃত্যু: ২৪১ হিজরি)। তিনি ছিলেন ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও ফকিহ। তিনি ‘মুসনাদে আহমদ’ নামক বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থের সংকলক, এবং চারটি প্রসিদ্ধ মাযহাবের একটি হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জীবন ছিল জ্ঞান, ত্যাগ, ধৈর্য ও ঈমানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিশেষ করে ‘ফিতনাতুল খালকিল কুরআন’ (কুরআন সৃষ্টি কি না এই বিতর্কে) তিনি যে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাঁর জীবনের আলোকিত ঘটনাটি ছিল একটা গভীর অর্থবোধক ঘটনা, যা আমাদের শেখায় তওবা ও ইস্তেগফার একজন সাধারণ মানুষকেও কেমন আল্লাহর নিকট মর্যাদা দিতে পারে। এক সফরে ইমাম আহমদ (রহঃ) এক শহরে রাতযাপন করতে গেলেন। রাত গভীর হয়ে যাওয়ায় তিনি এক মসজিদে আশ্রয় নিতে চাইলেন।
কিন্তু মসজিদের পাহারাদার তাঁকে ভেতরে থাকতে দিল না। তিনি বাইরে মসজিদের পাশে শুয়ে পড়লেন। পাহারাদার আবার এসে তাঁকে টেনে বের করে দিল। এসময় এক বেকার (রুটি বানানোর দোকানদার) তাঁকে দেখে বলল– ‘হুজুর, আপনি আমার দোকানে চলে আসুন, এখানে রাতটা কাটিয়ে যান।’
ইমাম আহমদ (রহঃ) তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, লোকটি রুটি বানানোর সময় মুখে বারবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলছে।
ইমাম আহমদ (রহঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত বেশি ইস্তেগফার কর কেন?’
লোকটি বলল, ‘হুজুর, আমি বহু বছর ধরে এই আমল করছি। আল্লাহর কসম, আমি যখনই কোনো দোয়া করি, আল্লাহ তা কবুল করেন একটি দোয়া ছাড়া।’
ইমাম আহমদ (রহঃ) বললেন, ‘সেটি কী?’ লোকটি বলল, ‘আমি বহু বছর ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন আমি ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর সাক্ষাৎ পাই।’ ইমাম আহমদ তখন কেঁদে ফেললেন এবং বললেন,
‘সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তোমার ইস্তেগফারের বরকতে আমাকে তোমার ঘরে এনে দিয়েছেন।’
এই ঘটনার তাৎপর্য ও তওবার শিক্ষা:
এই ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে তওবা ও ইস্তেগফারের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা:
১. ইস্তেগফার মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। একজন সাধারণ রুটি বিক্রেতা নিয়মিত ইস্তেগফার করার কারণে এমন একটি বরকত লাভ করেন, যা কোনো রাজা বা আলেমেরও ভাগ্যে জোটে না। ২. তওবা আল্লাহর নিকট সান্নিধ্যের মাধ্যম: ইমাম আহমদ (রহঃ)-এর জীবনের এই ঘটনা প্রমাণ করে, তওবা শুধু ক্ষমা পাওয়ার উপায় নয়, বরং এটি আল্লাহর কুরবতের (নিকটতা) একটি মাধ্যম। ৩. ইস্তেগফার দোয়া কবুলের চাবিকাঠি : যে ব্যক্তি ক্রমাগত ইস্তেগফার করে, তার দোয়া আল্লাহর দরবারে দ্রুত কবুল হয়। হাদীসে এসেছে ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করে, আল্লাহ তার প্রতিটি দুঃখ থেকে মুক্তির পথ তৈরি করেন এবং অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে রিজিক প্রদান করেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
৪. তওবা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে : ইস্তেগফার বান্দার অন্তরকে পরিষ্কার করে, আত্মাকে হালকা করে এবং আল্লাহর স্মরণে স্থিরতা আনে। ৫. তওবা আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের সোপান : যারা তওবা করে, আল্লাহ তাঁদের বিশেষ ভালোবাসা দান করেন। যেমন কুরআনে এসেছে ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল–বাকারা, ২:২২২), তওবার শর্ত ও সঠিক রূপ: তওবা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ইসলামী শরিয়তে তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছে: ১. গুনাহের প্রতি আন্তরিক অনুতাপ, ২. তাৎক্ষণিকভাবে গুনাহ ত্যাগ করা, ৩. আবার না করার দৃঢ় সংকল্প নেওয়া, ৪. যদি অন্যের অধিকার জড়িত থাকে, তাহলে তার হক আদায় করা।
আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ
ইমাম আহমদের ঘটনার বার্তা হলো, তওবা কেবল পাপ মোচনের প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি আল্লাহর সাথে পুনঃসংযোগের অনন্য অনুভব। যে হৃদয় ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ উচ্চারণে কেঁপে ওঠে, সেই হৃদয়ে আল্লাহর রহমত নেমে আসে।
এই কারণেই মহানবী স্বয়ং দিনে সত্তর বারেরও বেশি তওবা করতেন, যদিও তিনি ছিলেন নিষ্পাপ।
তিনি বলেছেন, ‘আমি দিনে সত্তর বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে তওবা ও ইস্তেগফার করি।’
(সহিহ বুখারী)
সমাজে তওবার প্রয়োজনীয়তা:
বর্তমান সমাজে অন্যায়, অসততা, হিংসা ও অশান্তি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মানুষের তওবা থেকে দূরে সরে যাওয়া। যদি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে তওবার সংস্কৃতি ফিরে আসে, তবে আত্মিক শান্তি ও নৈতিক পরিশুদ্ধি ফিরে আসবে।
পরিশেষে বলা যায় ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর জীবনের এই ঘটনা আমাদের শেখায়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের কত ভালোবাসেন, যদি তারা তাঁর দিকে আন্তরিকভাবে ফিরে আসে। তওবা ও ইস্তেগফার কেবল পাপ মুছে ফেলে না; এটি আল্লাহর রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে।
অতএব, আমাদের উচিত প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় নির্জনে বসে বলা: ‘আস্তাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিন কুল্লি জান্বিন ওয়া আতুবু ইলাইহ।’ (আমি আমার প্রতিটি গুনাহের জন্য ক্ষমা চাই এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসি।) তাহলেই হয়তো আমরাও আল্লাহর সেই বিশেষ অনুগ্রহের অধিকারী হব, যেমনটা হয়েছিল সেই রুটি বানানো মানুষটির।
লেখক : প্রাবন্ধিক









