ছোট বেলা থেকে বই পোকা ছিলাম। নতুন নতুন বইয়ের গন্ধ প্রচণ্ড ভালোবাসতাম, যা আজও বিন্দুমাত্র কমলো না। পানির অপর নাম যদি হয়ে থাকে জীবন এবং চোখের নাম দৃষ্টি আর আমার কাছে বইয়ের অপর নাম আলো বা দৃষ্টি শক্তি। জীবনের পরতে পরতে ঘন কুয়াশা ভেদ করে আলোর ছটা ছড়ায় যে সূর্য তারই নাম বই। বইয়ের জগতে যে একবার প্রবেশ করেছে একনিষ্ঠভাবে সেই কুড়িয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মণিমুক্তা। আমি একজন বইয়ের গ্রাহক, পাঠক ও সংরক্ষক। আমার আব্বাজান এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা এবং মরহুম দাদাজান মরহুম এম. আমিনুল্লাহও ছিলেন বইয়ের পোকা। নানা মরহুম এডভোকেট এজাহার হোসেইন বি.এল পঞ্চাশের দশকে মোমিন রোডে ‘দি স্ট্যান্ডার্ড লিটারেচার কোম্পানি লিঃ’ নামীয় একটি অত্যাধুনিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠান করেন। ঐ পাঠাগারে দেশী বিদেশী জার্নাল ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ থাকায় সুধিজনের আনাগোনা ছিল। এ কারণে আমার মরহুম আম্মাজানেরও পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল। আর আমার এই সুঅভ্যাস গুণে গুণান্বিত করতে সাহায্য করেছে আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম আব্বাজান। সময়টি ১৯৭১ আমার বয়স সবে মাত্র আনুমানিক ৯ বছর। বই পড়ে বুঝার মত বুদ্ধি যথেষ্ট হয়েছিল। নিজ জ্ঞানের পাঠাগার গড়ে তুলতে শিখে ফেলেছি। বাবা সব সময় বলতেন ‘বই ও সঙ্গীত এ দু‘টো কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না, এরাই জীবনের বন্ধু।’ তখনি কথাটা মনে বাসা বেঁধে ফেলে। সে ৯ বছর বয়সে বাবার সাথে প্রথম কারেন্ট বুক সেন্টার গিয়েছিলাম। সেখানে ক্যাশে বসেছিলেন আমিন চাচা, কর্মব্যস্ত হাতজোড়া, ক্যারোলিনের সাদা হাফশার্ট, চোখে কালো ফ্রেমের পুরো চশমা, মাথা ভর্তি টাক, শ্যামল বরণ সব মিলিয়ে রাশ ভারি চাচার। চাচার একটু মুচকি হাসি আজও চোখে ভাসে। তখনকার সময় চট্টগ্রামের কারেন্ট বুক সেন্টার নানা প্রকাশনা বিপননের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে ছিল অন্যতম। মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র রিয়াজুদ্দিন বাজার এবং বিপণীবিতানের মধ্যবর্তী জুবিলি রোডে অবস্থিত জলসা সিনেমা ঘরকে আলোকিত করে রেখে ছিল এই প্রতিষ্ঠান। সে গ্রন্থ বিপণীতে গিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম মোহাম্মদ আমিন চাচার। সে দোকানে অজস্র মানুষ এসে ভিড় জমতো। আজ যা শুধু স্মৃতি।
সেখানে যেকোন ম্যাগাজিন, ছড়া, পত্র–পত্রিকা, প্রকাশনা, কমিকস, কার্টুন, পুঁথিপত্র, গল্প বই ইত্যাদি বিভিন্ন সাহিত্য সম্ভার চাওয়া মাত্র পাওয়া যেত। মোবিন ভাই দোকানে বাবাকে সহযোগিতা করতেন, আমরা কী বই খুঁজছি বুঝে যেতেন। অনেক সময় স্কুল ছুটির পর কত বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে পড়ে ফেলেছি। আমিন চাচার মৃত্যুর পর তার ছেলে মোবিন ও শাহীন ভাইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। বড্ড বন্ধু বৎসল মানুষ। পিতার সংযোগগুলো এখনও রক্ষা করে চলেছেন। বর্তমানে পুরনো জলসা ভবনে দোকানটি নেই। পিতার স্মৃতি ধরে রেখেছেন দুইভাই। মিমি সুপার মার্কেটে মোমিন ভাই আর ভিআইপিটাওয়ারে শাহীন ভাই কারেন্ট বুক সেন্টারের দুটি শাখা চালু রেখেছেন। পাঁচ ভাই–বোনের (২ বোন ৩ ভাই) মধ্যে মোবিন ভাই বড়, শাহীন ও শামীম ছোট। বর্তমানে মিমি সুপার মার্কেটের ৩য় তলায় ও ভিআইপি টাওয়ারের ২য় তলা কারেন্ট বুক সেন্টারের শাখা রয়েছে। মূল শাখাটির পরিবেশগত কারণে রাখার সুযোগ রইল না। এক কথায় শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনবিদ, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, আমলা, কর্মজীবী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, নিবন্ধকার, কাল্পিক গল্পকার, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার, নারী পুরুষ সকল ধর্ম বর্ণ গোত্রের লোক সাহিত্য সুকুমারী মানুষের আড্ডা কারেন্ট বুক সেন্টার। গ্রন্থ বেচা–কেনার পাশাপাশি আমিন চাচা ক্রেতার সাথে খোশালাপে মগ্ন থাকতেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসের ত্রিশ তারিখে তিনি অসংখ্য গুণগ্রাহীকে ফাঁকি দিয়ে অন্তিম যাত্রায় রওনা দিয়েছেন।
মোহাম্মদ আমিন চাচা ১৯৩৩ সালে ঝালকাঠিতে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত তালুকদার পরিবারে তার জন্ম। কিন্তু তার আচরণে এবং আলাপে কখনো তালুকদার মনোভাব প্রকাশ পায়নি। বাবা হাজী আব্দুল হামিদ তালুকদার, মা বিবি রত্না। এগারো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫০ সালে তিনি পৈতৃক ব্যবসার কারণে বিখ্যাত জনপদ ঝালকাঠি তালুকদার বাড়ি হতে চট্টগ্রামে পাড়ি জমান। তখন সদ্য স্বাধীন দেশ পূর্ব পাকিস্তান। মাত্র তিন বছর পূর্বে বৃটিশ পরাধীনতার নাগপাশ হতে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। নিজেকে নিছক কোন সাধারণ ব্যবসার সাথে জড়াতে আগে থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তাই সে সময় বই ও পত্র পত্রিকার বিক্রিকে তিনি তার জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।তাছাড়া সে যৌবন বয়সে তার অন্তর জুড়ে চলছে শিক্ষা সংস্কৃতির ফাল্গুন হাওয়া। ১৯৫১ সালে স্বল্প পুঁজিতে কোতোয়ালী থানার বিপরীত দিকে রাস্তার ধারে পত্র–পত্রিকার দোকান দিয়ে জীবনের পথ চলা শুরু করেন এবং ১৯৬৯ সালে তিনি জলসা ভবনে ক্যারেন্ট বুক সেন্টার নামে গ্রন্থ বিপণি শুরু করেন। আর এই বিপণি পরিচিতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। দোকান সবসময় ক্রেতার সমাগমে জমজমাট থাকত। তাই আমিন চাচাকে চট্টগ্রামের পাঠক সৃষ্টির কারিগরও বলা হতো।শেষে লিখতে হবে, মহান প্রভু এ সৃষ্টিশীল মানুষটিকে উত্তম পুরস্কার দান করুন ।তিনি চলে গেলেও তাঁর কর্ম ও স্মৃতির মাঝে অনাদিকাল অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।










