গণতন্ত্র ও সংস্কার চাইলে বিএনপিকেই ভোট দিতে হবে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র বলেন, কেয়ারটেকার সরকার বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি বলেন– এদেশে যত সংস্কার হয়েছে সব বিএনপির হাত ধরেই হয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্র চাইলে, সংস্কার চাইলে বিএনপিকেই ভোট দিতে হবে। তিনি গতকাল বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব জুলাই বিপ্লব হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল আয়োজিত ‘আমার প্রথম ভোট ও আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। সেমিনারে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। বিএনপিকে কেন ভোট দেবে? এমন প্রসঙ্গ এলে আমীর খসরু বলেন, বাংলাদেশে প্রথম বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছে জিয়াউর রহমান, এ জন্য বিএনপিকে ভোট দেবেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ১৬ বছর আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন বেগম খালেদা জিয়া। সাত বছর জেলে ছিলেন, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস করেনি। বিএনপি বাংলাদেশে শুধু প্রথম গণতন্ত্র চালু করেনি, দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ তৈরি করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আগে অর্থনীতি ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটে–পকেটে। শেখ মুজিবের আমলে এটা ছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করে সেটা মানুষের পকেটে নিয়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষ কিন্তু শিল্প–বাণিজ্যে ঢুকতে পেরেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ বিএনপির হাত ধরে এসেছে।
আমীর খসরু বলেন, শুধু জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ– এই কালচার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন বাংলাদেশে নতুন কালচার তৈরি করতে হবে। সময় নষ্ট করা বন্ধ করুন। সভার মাঝখানে অমুক উপস্থিত আছেন, তমুক উপস্থিত আছেন– এসব বলার কী খুব দরকার আছে? সম্বোধন করতে গিয়ে বক্তব্যের সময় অর্ধেক আমরা নষ্ট করে ফেলি। বক্তব্যের শুরুতে সম্বোধনের প্রয়োজন নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, যারা স্টেজে আসবেন, মাইকে সরাসরি মূল পয়েন্টে কথা বলবেন। অতিরিক্ত সম্বোধন বা ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি সময়ের অপচয়। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সাধারণত রাজনীতিবিদরা বক্তৃতা দিয়ে চলে যায়, কিন্তু বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতিতে জনগণের সঙ্গে জবাবদিহিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দায়বদ্ধতার যে একটি প্রক্রিয়া, সেটি আমরা বিএনপিতে বিভিন্ন সভা ও সেমিনারের মাধ্যমে স্থাপন করছি। প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, বৃহৎ সভাগুলোতে বক্তৃতার সময় কমিয়ে, প্রশ্নোত্তর পর্ব দীর্ঘ করা হচ্ছে। ঢাকায় এবং আজ চট্টগ্রামে সুন্দর প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আমাদের নতুন রাজনীতির সংস্কৃতি। বিএনপির পরিকল্পিত অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ভবিষ্যতের মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়নে আমরা চারটি নীতি অনুসরণ করব ভ্যালু ফর মানি, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। ১৮ কোটি মানুষের জন্য আমাদের পরিকল্পনা হবে স্বচ্ছ ও সঠিক।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুব সমাজ ও মহিলাদের কর্মসংস্থানের প্রতি বিএনপি’র পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ কাজ করে খেতে পারেন। কিন্তু যারা এসএসসি, এইচএসসি, বা বিএ পাশ করেছেন তাদের ম্যানুয়াল কাজ করতে সমস্যা হয়। তাই আমরা এদেরকে আইটি স্কিলে ডেভেলপ করব। আইটি রিলেটেড কাজে ৬ মাস বা এক বছর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে সক্ষম হবে। মহিলারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও কাজ করতে পারবেন। আমাদের লক্ষ্য সবাইকে কর্মসংস্থানে আনতে হবে এবং অর্থনীতিকে গণতন্ত্রায়িত করা।
তিনি বলেন, আমরা চাই, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যুব সমাজ থেকে শুরু করে সবাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়নের সঙ্গে যুক্ত থাকুক। বাড়িতে বসেও মহিলারা বা পুরুষরা তৈরি পণ্য ডিজাইনিং ও ব্র্যান্ডিং সাপোর্টের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। এতে পণ্যের মান বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতিতে বিশাল অবদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। খসরু বলেন, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে জেন–জি। বিএনপি ও তারেক রহমান সেটি বুঝে পরিকল্পনা করেছে। আমাদের আগামীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনায় সবকিছু অন্তর্ভুক্ত আছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি মো. আবু হোরায়রার সভাপতিত্বও সাধারণ সম্পাদক এম রাজিবুল ইসলাম তালুকদার বিন্দুর পরিচালনায় সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও হাটহাজারী সংসদীয় আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়জী, বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য রাঙ্গুনিয়া থেকে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হুম্মাম কাদের চৌধুরী, বিএনপির আর্ন্তজাতিক বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. নসরুল কদির, ব্যারিস্টার ফয়সাল দস্তগীর।
সাংবাদিকদের যা বললে খসরু : এদিকে দলের প্রার্থী ঘোষণার পর গতকাল প্রথম চট্টগ্রাম আসেন। সকালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসার পর সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এরপর নগরীর মেহেদিবাগে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি।
নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, বিএনপির সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে আমরা একটি জনসম্পৃক্ত দল। নির্বাচনের জন্য আমাদের আলাদা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। আমরা জনগণের ওপর নির্ভর করেই রাজনীতি করি। ১৬ বছর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করে বিএনপি সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমাদের নেতাকর্মীরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, জীবনহানি হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, জেলে গেছে, মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে, চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা হারিয়েছে, তারপরও এই দলটি টিকে আছে শক্তিশালী অবস্থায় এবং আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী। সুতরাং আমরা যেহেতু জনসম্পৃক্ত একটা দল, আমাদের সবসময় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে।
শরিক দলকে আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, শরিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের সঙ্গে আমরা একসাথে আন্দোলন করেছি। সুতরাং আমরা যেখানে মনে করব, শরিকদের দিলে তাদের জেতার সম্ভাবনা আছে, সেখানে তাদের দিতে হবে। নির্বাচন কিন্তু হারজিতের বিষয়। নির্বাচন করতে হলে হেরে যাবার ঝুঁকি নেওয়া যায় না। সুতরাং জিততে হলে এমন প্রার্থীকে দিতে হবে, সেটা আমাদের দলের হোক কিংবা শরিক দলের হোক, সেই প্রার্থী সেখান থেকে বেরিয়ে আসার মতো, জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী হতে হবে।
প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি এমন আসন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খসরু বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে। বাকিগুলো ক্রমান্বয়ে হতে থাকবে। এটা নির্বাচনের সিলেকশনের একটা প্রক্রিয়া। তারপরও ২৩৭টা আসনে একসাথে প্রার্থী ঘোষণা করা, এটা অনেক বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি। এটা এত সহজ কাজ নয়, এর পেছনে বিশাল কর্মযজ্ঞ আছে। আরও কিছু বাকি আছে।
তিনি বলেন, এখানে একটা বিষয় হচ্ছে, যারা আমাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে, তাদের জন্যও আমাদের কিছু সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এই আলোচনা চলছে। বাকি সিট যেগুলো আছে, সেগুলো অতিসত্বর দেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে খসরু বলেন, এটা আন্দোলন নয়, সবার মতামত দেওয়ার একটা অধিকার আছে। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। আমাদের দলে বহু ধরনের চিন্তার লোক আছে। আমাদের এটা অ্যালাউ করতে হবে, যতক্ষণ না এটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে না যায়। প্রতিবাদ করার অধিকার সবার আছে, দল আবার চিন্তা করবে, কিন্তু সেটা যেন সাংঘর্ষিক না হয়। এটা যেন সহিংসতায় পরিণত না হয়, সহিংসতায় পরিণত হলে দল কিন্তু তার সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, বিএনপি সাংঘর্ষিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। এ জায়গাটা আমাদের নেতাকর্মীরা অনুধাবন করছে বলেই ২৩৭টা সিটের মধ্যে মাত্র ৪–৫টা সিটে প্রতিবাদ হচ্ছে। এর আগের নির্বাচনে এর চেয়ে অনেক বেশি প্রতিবাদ হয়েছে। বরং এবার কম প্রতিবাদ হয়েছে।
আমীর খসরু বলেন, আন্দোলন–সংগ্রামে ছিল, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতবড় একটা দল, কিছু সিটে সামান্য সমস্যা থাকতে পারে। ৩০০ সিটের মধ্যে ৫–১০ টা সিটে হয়তো বিশেষ কোনো কারণ থাকে, সেখানে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। এই স্যাক্রিফাইসটাতেও আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু বিজয় তো ছিনিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন হচ্ছে জয় অথবা পরাজয়, আমাদের তো জয়ের মধ্যে থাকতে হবে। এজন্য আমাদের ছোটখাট স্যাক্রিফাইস করতে হয়, কিন্তু জয়ের জন্য তো এতটুকু করতে হয়।












