দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মিষ্টি একটি আবহের মধ্যে ছুটছে আমাদের গাড়ি। রাত নেমে গেছে, তবে স্ট্রিট লাইটের আলোতে দু’পাশে প্রচুর গাছগাছালী দেখা যাচ্ছিলো। অনেকটা বনের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পিচঢালা রাজপথ ধরেই যেনো এগুচ্ছি। সারাদিনের পথ চলার ক্লান্তি যেনো কেটে যাচ্ছিলো অস্ট্রেলিয়ার সানশাইন কোস্টের আবহ দেখে। অসাধারণ পরিবেশ চারদিকে।

দুর্দান্ত একটি বাড়ির সামনে এসে ফয়সাল গাড়ি পার্ক করলেন। বললেন, আমরা পৌঁছে গেছি, এটিই আপুর বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে ভালো মনটি আরো ভালো হয়ে গেলো। অসাধারণ সুন্দর একটি বাড়ি ভাগিনীর। বাড়ির সামনেই রাস্তা, রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি পার্কের মতো, তারপরেই নদী। অর্থাৎ নদী পাড়ের বাড়ি বললেই ভুল বলা হবে না। নদীতে জোয়ার ভাটা আছে কিনা জানি না, তবে প্রচুর পানি। স্ট্রিট লাইটের আলোতে পানিগুলো চিক চিক করছিল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভাগিনী তাবাসসুম, তার বর সাজ্জাদ। বছর দুয়েক বয়সের তাদের একমাত্র সন্তান ইভান শাহরিয়ারও যেনো দাদুনানুর দেশ থেকে যাওয়া আত্মীয়ের জন্য মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছিল।

আমাকে পেয়ে ভাগিনীর পরিবারে খুশী বাঁধ ভেঙ্গেছিল। সাজ্জাদ এবং তাবাসসুমের উচ্ছ্বাস এবং আতিথেয়তায় আমার ক্লান্তি যেনো কোথায় মিলিয়ে গেল। রাতেই গোল্ড কোস্ট ফিরবো শুনে তারা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। ফয়সাল বললেন, কোন সমস্যা হবে না। আংকেলও গাড়ি চালাতে পারবেন। কিন্তু ভাগিনী জামাই সাজ্জাদ বললেন, কোনদিনই হবে না। আংকেলকে যেতে দেবো না। সানশাইন কোস্টের সবকিছু দেখিয়ে আমিই আংকেলকে গোল্ড কোস্টে রেখে আসবো। ফয়সালকেও থেকে যেতে বলা হলো। কিন্তু সকালে ফয়সালের চাকরি আছে, তাই তারপক্ষে থাকা সম্ভব নয়।

ফয়সালকে একা ছেড়ে দিতে আমার মনে সায় দিচ্ছিলো না। নতুন পরিচয়ের প্রাণবন্ত সঙ্গী ফয়সল অস্ট্রেলিয়ায় মেডিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র। দূরের দেশে থেকেও তিনি এমন আদরে পাশে থেকেছেন যে, মনে হয়নি আমরা নতুন পরিচিত। অন্যরকমের একটি মায়া টের পাচ্ছিলাম ফয়সালের জন্য। তাই তাকে একা ছাড়তে আমার কেমন যেনো লাগছিল। কিন্তু ফয়সালই বললেন, আংকেল, কোন সমস্যা নেই। আপনি বেড়ান। আমি চলে যেতে পারবো। এখানে তিনশ’ কিলোমিটার পথ কোন দূরত্বই না!ফয়সাল তখনি চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু সাজ্জাদ এবং তাবাসসুম ডিনার না করে তাকে কোনভাবেই যেতে দেবে না। টেবিলভর্তি নানা আয়োজন ডিনারে। আমরা সবাই বসে ডিনার সেরে নিলাম।

ফয়সাল বিদায় নিলেন। আমার খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিল না, ছেলেটিকে একাই পথে নামতে হলো। তিনশ’ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে এসে আবার ফিরতি পথে তিনশ’ কিলোমিটার গাড়ি চালানো শুধু উন্নত দেশগুলোতেই সম্ভব।

ফয়সাল চলে যাওয়ার পর সাজ্জাদতাবাসসুম বললো, আংকেল চলেন, নদীর পাড়ে ঘুরে আসি। বাসার সামনেই নদী, তাই ঘুরতে যেতে কোন সমস্যা নেই।

আমরা ঘর থেকে বের হলাম। দেখি, সাজ্জাদ গাড়ি বের করলো। আমি বললাম, নদী তো এখানেই, গাড়ি কেন? তাবাসসুম বললো, আমরা একটু দূরে যাবো আংকেল। একটি বিচ আছে, খুবই সুন্দর। সেখান থেকে ঘুরে আসি। আপনার হাতে সময় নেই, তাই যতটুকু সম্ভব ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনবো। ভাগ্য ভালো হলে, ক্যাঙ্গারুর দেখাও পেয়ে যাবো।

ক্যাঙ্গারুর কথা শুনে একটু পুলকিত হলাম। অস্ট্রেলিয়ার এই প্রাণীটির দর্শন এখনো মিলেনি। এই রাত বিরাতে যদি ক্যাঙ্গারু দর্শন হয় তো মন্দ কি! আমরা যাত্রা করলাম। রাতের সানশাইন কোস্ট শহর ঘুরিয়ে তারপর বিচে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বললো সাজ্জাদ।

সানশাইন কোস্ট অস্ট্রেলিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যটন এলাকা। প্রতি বছর লাখ লাখ বিদেশী পর্যটক এই এলাকায় ঘুরতে আসেন। তাই জীবনযাত্রার মান কিছুটা বেশি। সাগরের পাশাপাশি প্রচুর পাহাড়ী অঞ্চলও সানশাইন কোস্টে রয়েছে। রাতের বেলায়ও পাহাড় দেখা যাচ্ছিলো। কোন কোন পাহাড়ে জ্বলছিল বৈদ্যুতিক বাতি। ওখানেও বাড়িঘর আছে। বিস্তৃত এলাকা, লোকসংখ্যা চার লাখের কিছু বেশি। তাই হাইরাইজ বিল্ডিং তেমন একটা চোখে পড়লো না। বাড়িগুলোও অধিকাংশই একতলা, তবে কিছু কিছু দুই তিন তলা উচ্চতার। বাড়ি নির্মাণে ইউরোপের ধাঁচ স্পষ্ট।

আমরা শহরের ভিতর চক্কর মারছিলাম। তবে অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ। তবে প্রতিটি ভবনই আলোকোজ্জ্বল, সুন্দর। নাইট ক্লাব ও বারগুলো থেকে আলোর ঝিলিক ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছিলো। খাবারের কিছু কিছু দোকানপাটও খোলা দেখলাম। সাজ্জাদ আমি কিছু খাবো কিনা জানতে চাইলো। ডিনারের এক ঘন্টার মধ্যে আবার খাওয়া দাওয়া অসম্ভব বলে সামনে এগুতে বললাম।

আমরা একটি বিচে পৌঁছলাম। এমন সুন্দর করে সাজানো গোছানো বিচ দেখলে মন ভালো হয়ে যায়, আবার খারাপও। পৃথিবীর দৈর্ঘ্যতম বিচ থেকেও আমরা কত পিছিয়ে। অথচ সানশাইন কোস্টের ছোট্ট একটি বিচ কী যে সুন্দর! বিচ এবং আশপাশে আলোআঁধারির খেলা। আরো কিছু লোকজনও রয়েছে, রয়েছে নারী পুরুষ। বিচের পাশে সবুজে আচ্ছাদিত মাঠের মতো পাড়। যেনো একটি গলফ কোর্স। সেখানে বসার জায়গা যেমন রয়েছে, রয়েছে বার বি কিউ করার জন্য চুলার আয়োজন। নাগরিকেরা এখানে এসে নিজেদের মনের মতো করে সময় কাটায়, বার বি কিউ করে। শিশুরা মাঠে দৌড়ায়, বিচের বালিতে গড়াগড়ি খায়। কেউ কেউ সূর্যস্নানও করে।

আমরা বিচজুড়ে হাঁটাহাঁটি করলাম, ইভানকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সে কখনো হামাগুড়ি, কখনো বা ছোটাছুটির চেষ্টা করছে। পড়ছে, নিজে নিজে উঠছে! তার আনন্দ সবার থেকে বেশি। আমরা একটি বেঞ্চে বসলাম। কাঠের বেঞ্চ। বিচের পাশে বেঞ্চ স্থাপন করে রাখা হয়েছে। যাতে নাগরিক কিংবা পর্যটকেরা বেঞ্চে বসে বিচ উপভোগ করতে পারে। সাজ্জাদ কোত্থেকে আইসক্রিম কিনে নিয়ে এলো। আমার হাতে দিয়ে বললো, আংকেল, এটা খান। ভালো লাগবে।

ঠান্ডার মধ্যে আইসক্রিম। হাসতে হাসতে হাত বাড়ালাম। কিন্তু খেতে গিয়ে মনে হলো, আইসক্রিমের স্বাদটি অসাধারণ। অস্ট্রেলিয়া দুধের জন্য বিখ্যাত। অস্ট্রেলিয়ান গুড়ো দুধের নাম করে আমাদেরকে যে কত কিছু খাইয়ে দেয়া হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই অস্ট্রেলিয়ান দুধের আইসক্রিমের স্বাদ তো কিছুটা ভিন্ন হবেই!

সাজ্জাদতাবাসসুম তাদের বাচ্চাকে নিয়ে খেলা করছিল, আমি বিচে নেমে পড়লাম। চিকচিক করছে বালু, শুকনো। বালুর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটি ফোনকল সেরে নিলাম। বিশেষ করে রাতে যে ফিরছি না সেটা জানিয়ে দিলাম, রুমমেট বিজয়’দাকে। ফজলে করিম ভাইকেও ফোনে খোঁজখবর নিলাম। রাতে ফিরবো না শুনে দুজনই মন খারাপ করলেন। তবে বললেন যে, এতোদূর যখন গিয়েছেন, না ফিরে ভালোই করেছেন। দেখে শুনে আসুন। আপনার মাথায় তো আবার পোকা আছে! হাসলাম। আমার লায়নিজমের এই দুই বন্ধুর সাথে বহুদেশে একসাথে গিয়েছি। আমার ঘোরাঘুরির বাতিকের জন্য তারা আমার মাথায় পোকা আছে বলে মনে করেন।

অনেক রাত অব্দি ঘুরলাম বিচে। আকাশে ভরা চাঁদনি। চাঁদের আলোতে বিচের আবহই পাল্টে গেছে। বিচে লাইটও রয়েছে। লাইটের আলোর সাথে চাঁদের আলো মিলেমিশে একাকার। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ খেলা করছিল। দূরে দুয়েকটি নৌযানও দেখা গেলো। আলো জ্বলছিল। কেউ হয়তো ভাসমান ইয়ট নিয়ে চাঁদনী দেখছে। পৃথিবীতে সুখী মানুষের অভাব নেই। তারা নিজেদের মতো করে সময় কাটায়, জ্যোৎন্সায় স্নান করে, জঙ্গলে হাওয়া খায়।

হঠাৎ আমার মনে হলো ক্যাঙ্গারুর কথা। সাজ্জাদকে বলতেই তারও যেনো মনে পড়লো। বললো, আংকেল এখনোও তো দেখলাম না। চলেন, আরেকটি জায়গায় যায়, ওখানে হয়তো দেখা পাবো।

আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। সাজ্জাদতাবাসসুম কি একটি জায়গার নাম বললো। ক্যাঙ্গারু দেখার জন্য আমরা সেখানে যাচ্ছি। আবারো গাছগাছালীতে ঢেকে থাকা পথঘাট মাড়িয়ে কখনো পাহাড়ী রাস্তা ধরে আমরা একটি মাঠে এসে দাঁড়ালাম। পাশেই কোন সেনাছাউনী বলে মনে হলো।

বিশাল মাঠ, সবুজ ঘাষে ভরা। এখানে নাকি প্রতিদিনই ক্যাঙ্গারুর দল খেলতে বের হয়, ছুটাছুটি করে। মানুষ দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকে।

সাজ্জাদ গাড়ির লাইট বন্ধ করে দিল। আমরা নরোম তুলতুলে সবুজ ঘাসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলো চারদিক ভেসে যাচ্ছে। ক্যাঙ্গারু বের হলে নিশ্চয় দেখা হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ক্যাঙ্গারুর দেখা পেলাম না। সাজ্জাদ বললো, রাতের বেলায় ক্যাঙ্গারুর চলাচল কমে যায়। সন্ধ্যার আগ দিয়ে বেশি দেখা যায়।

ক্যাঙ্গারু নিয়ে মানুষের যত গল্পগাঁথা, তা শুনতে শুনতে ক্যাঙ্গারুর প্রতি এক ধরনের ফ্যান্টাসি তৈরি হয়েছে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ক্যাঙ্গারুর দেখা মিললো না। তবে বেশ বড়সড় একটি ইঁদুরের দেখা পেলাম। এতো বড় ইঁদুর আমি চিড়িয়াখানাতেও দেখিনি। কিন্তু সাজ্জাদ বললো, আংকেল, এটা ইঁদুর নয়, এটার নাম পোসাম। অস্ট্রেলিয়ান এক ধরনের নেটিভ রোডেন্ট প্রজাতি। আসল ইঁদুর নয়, কিন্তু ইঁদুরের মতো। দেখতেও, চাল চলনেও। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে অস্ত্রসহ হত্যা ও অস্ত্র মামলার আসামি গ্রেফতার
পরবর্তী নিবন্ধমেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের এক বছর পূর্তি : একটি মূল্যায়ন