বিদ্যুৎ খাতকে সার্বিকভাবে ঝুঁকিমুক্ত করা উচিত

| বুধবার , ৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

সরকার গঠিত বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা বলেছেন, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল। তাঁরা বলেছেন, চুক্তিতে ব্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে। তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোকএমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহউপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

এ বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসাবাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে না রেখে বিদ্যুৎ বিভাগ দেশের জনসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত হওয়া উচিত। বিদ্যুৎ খাত পরিচালনায় প্রয়োজন দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তির। বিশেষ করে এ খাতে চুক্তি, ভোক্তার অধিকার, এমনকি কম মূল্যে বিদ্যুৎসেবার বিষয়টি যিনি নিশ্চিত করতে পারবেন এমন একজন ব্যক্তির এখানে দায়িত্বে থাকা উচিত। তাতে একদিকে যেমন এ খাতের উন্নয়নে গতি পাবে, অন্যদিকে অর্থনীতির সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের জোরালো সম্পৃক্ততা থাকবে। রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় রাজনৈতিক স্বার্থেই বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেখা গেছে। দেশের জনকল্যাণের স্বার্থে রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয় বরং পরামর্শেই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় স্বনির্ভর সিদ্ধান্তে পরিচালিত হওয়া উচিত। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কোনো প্রকল্পের চুক্তি করা হলে একদিকে যেমন ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়, অন্যদিকে লুটপাটের সুযোগও কম থাকে। বরং থাকে দায়বদ্ধতা। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিগত দেড় দশকের শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো ন্যায্যতা ছিল না। উপরন্তু সরকার সমর্থিত কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিকে এ খাত থেকে অর্থ লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। আর এসব দুর্নীতি আড়াল করতে করা হয়েছিল দায়মুক্তি আইন। এ আইনের আওতায় বিনা টেন্ডারে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল সরকারঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের। এতে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা সরিয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নষ্ট করা হয়েছে বিদ্যুতের প্রতিযোগিতামূলক বাজার। উচ্চ মূল্যের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেকই কোনো কাজে না এলেও দেশ ও জনগণের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে ঋণের বোঝা। জনগণের পকেট থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে বিদ্যুতের বাড়তি মূল্য পরিশোধের জন্য। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশ বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা না থাকায় নতুন করে ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। তাই বিদ্যুৎ খাতকে সার্বিকভাবে ঝুঁকিমুক্ত করা উচিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে