কক্সবাজার–সেন্টমার্টিন নৌরুটে গতকাল শনিবার থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের কথা থাকলেও যাত্রী সংকটের কারণে কক্সবাজার থেকে কোনো জাহাজ ছেড়ে যায়নি। এতে কিছু পর্যটক ঘাটে এসে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও প্রশাসনের তদারকি করা হয়। কিন্তু জাহাজ চলাচল না করায় কার্যক্রম জোরদার করা হয়নি। ঘাটে আসা পর্যটকরা হতাশা প্রকাশ করে এই অব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসন ও জাহাজ মালিকদের দোষারোপ করেছেন। তারা বলেছেন, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন যেতে না পারায় তারা হতাশ হয়েছেন।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল ১ নভেম্বর সকালে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টিকিট নিয়ে জাহাজে উঠতে কক্সবাজার শহরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে আসেন ফরিদপুর থেকে আসা পর্যটক শামীম খান। কিন্তু কাউন্টারে টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। জাহাজও নেই। তাই বাধ্য হয়ে ঘাট থেকে ফিরেছেন তিনি। শুধু তিনি নন, সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেতে আরো পর্যটক এসেছিলেন ঘাটে। সবাই ফিরেছেন হতাশ হয়ে। পর্যটকদের দাবি, নভেম্বরেও সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপনের অনুমতি দেয়া হোক।
চলতি মৌসুমে প্রশাসনের অনুমতি পাওয়া জাহাজ কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাদের মতে, নভেম্বর মাসে সেন্টমার্টিনে রাতযাপনে নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রবাল দ্বীপটি ভ্রমণে পর্যটকদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা কাজ করছে।
সেন্টমার্টিন রুটের পর্যটকবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ–স্কোয়াব থেকে জানানো হয়েছে, এখন পর্যটকের সাড়া মেলেনি, তাই জাহাজ ছাড়া হয়নি। ডিসেম্বর মাসে সেন্টমার্টিনে রাতযাপনে নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই তখন দ্বীপে পর্যটকের সংকট থাকবে না। এ কারণে ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানিয়েছেন, ১ নভেম্বর থেকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়ারছড়ায় বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট দিয়ে জাহাজ ছাড়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু যাত্রী সংকটের কারণে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে জাহাজ ছাড়া সম্ভব হয়নি।
তিনি জানান, তার প্রথম কারণ সরকারি সিদ্ধান্তে শর্তের বেড়াজাল। শর্ত মতে নভেম্বরে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন গেলেও রাত্রিযাপনের সুযোগ নেই। দিনে গিয়ে দিনে তাদের কক্সবাজার ফিরতে হবে।
কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বাঁকখালী নদীর ঘাট থেকে পর্যটনবাহী জাহাজ সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটিঘাটে পৌঁছতে সময় লাগে ৭ থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টা। ফলে দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে জাহাজে সমুদ্রযাত্রায় সময় প্রয়োজন ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা। জোয়ার–ভাটা এবং আসা–যাওয়ার জন্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনে পৌঁছে জাহাজ অপেক্ষা করতে পারবে এক ঘণ্টা। ফলে ১৫ ঘণ্টার সমুদ্র যাত্রা শেষে ১ ঘণ্টার দ্বীপ ভ্রমণে ইচ্ছুক নন পর্যটকদের বেশিভাগ।
তিনি জানান, কিছু সংখ্যক পর্যটক দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে আগ্রহী। এদের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ১ থেকে দেড়শত। কিন্তু এই ১ থেকে দেড়শত যাত্রী নিয়ে জাহাজ চলাচল সম্ভব না। একটি জাহাজ সাড়ে ৩শত যাত্রী না পেলে দ্বীপে আসা–যাওয়া করতে পারে না। তার কারণ জাহাজের খরচ। একটি জাহাজ আসা–যাওয়ার জন্য জ্বালানি, জাহাজের নাবিকসহ অন্য কর্মচারী, ঘাটের টোল, সরকারি ভ্যাটসহ সকল মিলে খরচ ১০ লাখ টাকার কম–বেশি। ফলে ১ থেকে দেড়শত যাত্রী পেলেও কক্সবাজার শহর থেকে সেন্টমার্টিন আসা যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অপরদিকে উখিয়ার ইনানীস্থ নৌ বাহিনীর জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল করলে সময় কমবে যাওয়া আসায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। এই জেটি দিয়ে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টায় আসা–যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনে জাহাজ আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করার সুযোগ আছে। কিন্তু পরিবেশগত কারণে ওই জেটি দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমতি নেই। টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে সময় আরো কম। যাওয়া আসা ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। কিন্তু মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সাথে জান্তার সংঘাত, নাফ নদী থেকে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া আর গোলাগুলির নিরাপত্তাজনিত কারণে তা সম্ভব না। ফলে জাহাজ মালিকরা নভেম্বরে জাহাজ চলাচলের জন্য রাজি নন।
স্কোয়াবের সভাপতি তোফায়েল আহম্মদ বলেন, পর্যটকদের আশানুরূপ সাড়া পেলে কোনো জাহাজ বসে থাকবে না। পর্যটক না পেলে খালি জাহাজ চালিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয়। দুই–আড়াইশ পর্যটক সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু এই পর্যটক নিয়ে তো জাহাজ চলাচল করা সম্ভব নয়। তাই জাহাজ চলাচল শুরু করা যায়নি। মূলত দিনে গিয়ে দিনে চলে আসতে হবে, তাই পর্যটকদের আগ্রহ নেই। গত বছরের মতো ডিসেম্বর–জানুয়ারি জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
সরকারি সিদ্ধান্ত মতে, বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে পর্যটকদের মানতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আ. মান্নান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনও পর্যটক ও জাহাজ মালিকদের জন্য সব ধরনের সেবা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু যাত্রা শুরুর প্রথম দিনে কোনো জাহাজ চলাচল করেনি। এতে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আগ্রহী পর্যটকেরা সেন্টমার্টিন যেতে পারেনি বলে শুনেছি। এই বিষয়ে জাহাজ মালিকদের সাথে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত পর্যটক না পাওয়ায় জাহাজ ছাড়তে পারেনি। এই বিষয়ে করণীয় সংশ্লিষ্ট সবার সাথে ঠিক করার চেষ্টা চলছে।
        











