সংকোচ ছেড়ে আত্মবিশ্বাসের পথে এগিয়ে যেতে হবে

সাইফ চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আত্মবিশ্বাস। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এই শক্তিকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে না, কারণ তারা নিজের মনের ভেতর লালন করে সংকোচ, ভয় ও দ্বিধা। সংকোচ মানুষকে থামিয়ে দেয়, আত্মবিশ্বাস মানুষকে এগিয়ে দেয়। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যেমন পারিবারিক, শিক্ষা, কর্মজীবন বা সমাজে আত্মবিশ্বাসী মানুষই গড়ে তোলে সাফল্যের গল্প। তাই আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকেরই শিখতে হবে, সংকোচ ছেড়ে আত্মবিশ্বাসের পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় পরিকল্পনা।

সংকোচ হল অগ্রগতির অদৃশ্য শত্রু: সংকোচ হলো এমন এক মানসিক দেয়াল, যা আমাদের ক্ষমতাকে বন্দি করে রাখে। এটি জন্মগত নয়, বরং সামাজিক ও পারিবারিক চাপে, লজ্জা বা ব্যর্থতার ভয়ে তৈরি হয়। যেমন ক্লাসে প্রশ্ন করতে সংকোচ, নতুন কাজে হাত দিতে দ্বিধা, নিজের মতামত প্রকাশে ভয় সবই আমাদের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দেয়। সংকোচ মানুষকে একাকী করে তোলে, তার প্রতিভা ও চিন্তাকে নিভিয়ে দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভুল করা কোনো অপরাধ নয়, বরং শেখার অপরিহার্য ধাপ। যারা ভয় না পেয়ে ভুলের মধ্য দিয়েই শিক্ষা নেন, তারাই আত্মবিশ্বাসের সোপানে পৌঁছান।

আত্মবিশ্বাস মানে সাফল্যের মূলভিত্তি: আত্মবিশ্বাস মানে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা, ‘আমি পারব’ এই দৃপ্র মনোভাব। এটি শুধু সাহস নয়, এক ধরনের স্থিতিশীলতা, যা মানুষকে কঠিন সময়েও টিকিয়ে রাখে। আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তি নিজের কাজ, লক্ষ্য ও সম্পর্কের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ জানেন, সাফল্য আসে নিয়মিত প্রচেষ্টা, শৃঙ্খলা ও নিজের উপর আস্থার মধ্য দিয়ে। তিনি কারো সাফল্যে ঈর্ষা না করে নিজের উন্নয়নে মন দেন।

আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলে নেতৃত্বগুণ: নেতৃত্বগুণ বলতে বোঝায় এমন এক ক্ষমতা, যার মাধ্যমে একজন মানুষ অন্যদের পথ দেখায়, অনুপ্রাণিত করে এবং একসাথে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু নেতৃত্ব কেবল কথায় আসে না এর ভিত্তি হলো দৃপ্র আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসী নেতা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, ভুল করলে তা স্বীকার করেন, এবং নতুনভাবে চেষ্টা করার সাহস রাখেন। তিনি অন্যদের মতামতকে শ্রদ্ধা করেন, ভেবে কথা বলেন এবং সবার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখেন।

পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধ: আত্মবিশ্বাসী মানুষ শুধু নিজের উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকেন না; তিনি অন্যের প্রতিও স্নেহ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক অবিকৃত রাখাই সুস্থ সমাজের ভিত্তি। সংকোচপ্রবণ মানুষ প্রায়ই সম্পর্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন্ত কেউ অতিমাত্রায় ভীত, কেউ অহমিকাপ্রবণ। অথচ আত্মবিশ্বাসী মানুষ জানেন, কিভাবে নিজের মর্যাদা বজায় রেখে অন্যকেও সম্মান করতে হয়। এই ভারসাম্যপূর্ণ আচরণই তাকে করে তোলে প্রিয়, গ্রহণযোগ্য ও নেতৃত্বদানে সক্ষম।

প্রাপ্য মনোযোগ ও কথার সংযম: আত্মবিশ্বাসী মানুষ জানেন, নিজের প্রাপ্য মর্যাদা ও মনোযোগ পেতে হলে আগে নিজের যোগ্যতা ও কাজের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। সম্মান কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না, এটি অর্জন করতে হয় সততা, পরিশ্রম ও সঠিক আচরণের মাধ্যমে। কথার সংযম আত্মবিশ্বাসের অন্যতম লক্ষণ। ভেবে কথা বলা, সঠিক সময়ে মতামত দেওয়া এবং প্রয়োজনে নীরব থাকা। এগুলোই পরিণত মনের পরিচয়। অযথা বিতর্কে না জড়িয়ে শান্তভাবে যুক্তিসঙ্গত কথা বলা মানুষকে মর্যাদাবান করে তোলে।

মর্যাদা রক্ষায় দৃপ্র থাকা মানে অহংকার নয়; বরং ন্যায় ও সত্যের পক্ষে স্থির থাকা। আত্মবিশ্বাস মানুষকে এমন সাহস দেয়, যাতে সে অন্যায়ের সামনে কখনো মাথা নত না করে, আবার অযথা কারও প্রতি কঠোরও না হয়। যে ব্যক্তি নিজের আচরণে সংযমী, কথায় ভদ্র, আর কাজে দৃপ্র হয়, সেই সত্যিকারের আত্মবিশ্বাসী মানুষ।

কথার সংযম বা ভেবে বলাই শ্রেয়: আত্মবিশ্বাসের অন্যতম লক্ষণ। যে ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসী, সে জানে কখন কথা বলতে হবে, কখন নীরব থাকতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ে, যুক্তিসঙ্গত ও চিন্তাশীলভাবে মত প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মর্যাদা রক্ষায় দৃপ্র প্রতিরোধ মানে অহংকার নয়, বরং সৎ ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকা। আত্মবিশ্বাস মানুষকে এমন স্থিতিশীলতা দেয়, যা তাকে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করতে দেয় না।

সম্পর্কের ভারসাম্য ও নিজেকে উন্নত করা: জীবন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যেমন ভালোবাসা দরকার তেমনি দরকার ভারসাম্য ও আত্মসম্মান। সংকোচে ভোগা মানুষ প্রায়ই সম্পর্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে কেউ অতিরিক্ত আত্মসমর্পণ করে, কেউ আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অথচ আত্মবিশ্বাসী মানুষ জানেন, কিভাবে নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়। নিজেকে উন্নত করাই সম্পর্ক রক্ষার শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। যখন আমরা নিজেকে শিক্ষিত, ভদ্র, দক্ষ ও সংবেদনশীল করে তুলতে পারি। তখন আমাদের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসও বৃদ্ধি পাবে। নিজেকে উন্নত করা মানে কেবল ডিগ্রি বা পদোন্নতি নয়; বরং মানসিক পরিপক্বতা, সহানুভূতি, ধৈর্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও এর অন্তর্ভুক্ত।

চিন্তাশীলতা, যুক্তি ও দক্ষতার উৎকর্ষতা: আত্মবিশ্বাস অন্ধ বিশ্বাস নয়। এটি যুক্তিনির্ভর মানসিক দৃপ্রতা। যে মানুষ চিন্তাশীল, সে ভেবে কথা বলে, পরিমিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। চিন্তাহীন আত্মবিশ্বাস অহংকারে রূপ নেয়, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত আত্মবিশ্বাস মানুষকে করে জ্ঞানী ও মর্যাদাবান। তাই চিন্তাশীল ও যুক্তিসঙ্গত কথা বলার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। এই অভ্যাস শুধু ব্যক্তিত্ব উন্নয়নেই নয়, পেশাগত ও সামাজিক জীবনের জন্যও অপরিহার্য।

লক্ষ্য, কর্মব্যস্ততা ও আত্মবিশ্বাসের চর্চা: আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে হলে জীবনে লক্ষ্য থাকা জরুরি। লক্ষ্যহীন মানুষ সহজেই হতাশ হয়, ভয় পায় এবং সংকোচে ভুগে। অন্যদিকে যিনি নিজের লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে জানেন, তিনি প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়েও অনুপ্রাণিত থাকেন। কর্মব্যস্ততা মানে শুধু ব্যস্ত থাকা নয়, বরং ফলপ্রসূ কাজের মাধ্যমে নিজের উন্নয়নে অবদান রাখা। আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনো অলস থাকে না; সে জানে, পরিশ্রমই আত্মবিশ্বাসের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। যিনি লক্ষ্য ঠিক রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন তিনি আসল অর্থে আত্মবিশ্বাসী ও সফল মানুষ।

সংকোচ আমাদের সম্ভাবনাকে আটকে রাখে, আত্মবিশ্বাস তা মুক্ত করে। আত্মবিশ্বাস মানে কেবল নিজের ওপর ভরসা নয়, বরং পারস্পরিক স্নেহ, শ্রদ্ধা, সম্পর্কের ভারসাম্য ও সংযমের মধ্য দিয়ে পরিণত মানুষ হয়ে ওঠা।

সংকোচ দূর করার উপায়:-

. নিজেকে ভালোভাবে জানুন ও মেনে নিন নিজের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হোন। কেউই পরিপূর্ণ নয়। নিজের মতো করে নিজেকে গ্রহণ করতে পারলেই আত্মবিশ্বাস জন্মায়। ২. ছোট সাফল্যে আনন্দ খুঁজুন প্রতিটি ছোট সাফল্য বড় স্বপ্নের দিকে একধাপ এগিয়ে দেয়। ছোট জয়ে খুশি হতে শিখলে মন সাহসী হয়। ৩. ভুলকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা ভুল করা লজ্জার নয়, বরং শেখার সুযোগ। ব্যর্থতা শেষ নয়। এটি নতুন সূচনা করার প্রেরণা। ৪. প্রতিদিন নিজেকে বলুন, ‘আমি পারব, আমি চেষ্টা করব।’ নিজের প্রতি বিশ্বাসই সংকোচ ভাঙার প্রথম চাবি। সবসময় সামনে থাকলে মানুষ গুরুত্ব দিতে শেখে না। মাঝে মাঝে আড়ালে থাকা আপনার উপস্থিতিকে আরও মূল্যবান করে তোলে। ৫. যত বেশি জানবেন, তত আত্মবিশ্বাসী হবেন। নতুন কিছু শেখার আগ্রহ সংকোচকে দূরে সরিয়ে দেয়। ৬. ভয় না পেয়ে নিজের মতামত বলুন, প্রশ্ন করুন, অংশ নিন। শুরুতে দ্বিধা থাকবে, কিন্তু ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে।

যে মানুষ আত্মবিশ্বাসী, সে জানে কখন কথা বলতে হবে, কখন নীরব থাকতে হবে। সে নিজের মর্যাদা রক্ষা করে, আবার অন্যের প্রতি সম্মানও দেখায়। সম্পর্কের ভারসাম্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্যই তার জীবনের দিশারী হয়ে ওঠে। নিজেকে উন্নত করায় আত্মবিশ্বাসের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, চিন্তাশীলতা এবং দক্ষতার চর্চার মাধ্যমেই আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। যুক্তি ও প্রজ্ঞার সঙ্গে কথা বলা, লক্ষ্যভিত্তিক কর্মব্যস্ততা বজায় রাখা, আর নিজের কাজে উৎকর্ষতা আনা, এসবই আমাদের অন্তরকে শক্তিশালী করে তোলে। আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনো অহংকারে ভোগে না। বরং সে জানে নিজের মর্যাদা ও মানবিকতা একে অপরের পরিপূরক। লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৃদয়ে ধরা দিবে সোনালি বিশ্বাস
পরবর্তী নিবন্ধমধ্যযুগে ভারতীয় সংগীতে ইসলামী প্রভাব