দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মনে হলো মহাসাগর স্পর্শ করেই নামলো আমাদের বোয়িং। গোল্ড কোস্ট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরেই রাতেদিনে খেলা করে প্রশান্ত মহাসাগর। ল্যান্ডিংয়ের সময় বিমানগুলোও বুঝি এই খেলার সাক্ষী হয়। বিমান পানিতে পড়ে যাচ্ছে মনে হলেও ভয় পাচ্ছিলাম না। কারণ দুনিয়াতে সাগরের কাছের এয়ারপোর্টগুলোতে বিমান এভাবেই অবতরণ করে। আমার খুব মনে পড়ছিলো মালদ্বীপের মালে, থাইল্যান্ডের ফুকেট, জাপানের নারিতা, আমেরিকার সান ডিয়াগো, ইন্দোনেশিয়ার বালি এবং হংকং বিমানবন্দরের কথা। আরো কোথায় কোথায় যেনো সাগর ছোঁয়া বিমানবন্দর দেখেছিলাম। আমাদের চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও কর্ণফুলীর বুকের উপর দিয়ে বিমান ল্যান্ড করে।

অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চমৎকার একটি ল্যান্ডিং উপহার দিলেন পাইলট। কোন ধাক্কা খেলাম না, যেনো আলতো করে রানওয়ের কোলে চড়ে দৌঁড়ানো শুরু করলো বিশাল বোয়িং।

আধুনিক বিশ্বে যে কোন বিমানবন্দরে বিমান রানওয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথেই দারুণ একটি ব্যাপার ঘটে। বিমানের ভিতরে অসংখ্য ফোন বাজতে শুরু করে। এর থেকে বুঝা যায় যে, যাত্রীদের স্বজনেরা কী পরিমান উদগ্রীব থাকেন!

আমার ফোনটিও বেজে উঠলো। গোল্ড কোস্টে আমাকে রিসিভ করতে আসা ফয়সাল ফোন করে খবর নিলেন। কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, আমি পার্কিংয়ে ঢুকছি না, বাইরে অপেক্ষা করছি। আপনি বের হয়ে ফোন দিলে আমি গেটে চলে আসবো, দুই মিনিট লাগবে।

ফোন রেখে মনে মনে ভাবলাম, চিনি না, জানি না। অথচ আমাকে নেয়ার জন্য কী অধীর অপেক্ষা!

ফয়সালের একটু পরিচয় দিই। তার বাড়ি ঢাকায়, থাকেন গোল্ড কোস্টে। পড়েন মেডিকেল সায়েন্সে। আমার খুব কাছের বন্ধুর ভাগিনার ক্লাসমেট, বন্ধু। বন্ধুর ভাগিনা বাবু দেশে বেড়াতে চলে এসেছে, তাই আমাকে রিসিভ করে তার বোনের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছে তার বন্ধু ফয়সালকে। ফয়সাল তার প্রিয় বন্ধুর অনুরোধ রাখতে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো আমাকে রিসিভ করতে এসেছেন, নিয়ে এসেছেন নিজের গাড়ি।

ট্যুর অপারেটর থেকে আমাদের হোটেলে নেয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখা হলেও আমি বন্ধুর ভাগিনীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য দলছুট হয়ে গেলাম। সবাই বাসে চড়লেও আমি ফয়সালের দারুণ একটি নিশান গাড়িতে চড়ে বসলাম।

ফয়সাল বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর আসার পর বললেন, আংকেল,চলেন কিছু খেয়ে নিই। ক্ষুধা লেগে যাবে।’ ক্ষুধা লাগবে কেন? যেতে কতক্ষণ লাগবেজানতে চাইলাম। ফয়সাল বললেন, তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা লাগবে। ট্রাফিক থাকলে আরো একটু বেশিও লাগতে পারে! কি বলেন! চমকে উঠলাম আমি। কত দূরে যাবো? বলে ফয়সালের মুখের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার! আমি ভিতরে ভিতরে ঘামতে লাগলাম! এতোদূরে গিয়ে ফিরে আসবো কি করে? রাতে তো আমাদের থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা এখানেই করা আছে। ফয়সাল বললেন, আংকেল, কোন ব্যাপার নয়। রাতেই চলে আসতে পারবো। আমি শুনেছি, আপনার ইন্টারন্যাশনাল লাইসেন্স আছে। আসার সময় নাহয় আপনিও কিছুক্ষণ গাড়ি চালাবেন।

বন্ধুর ভাগিনীর বাড়িতে যাচ্ছি। খুবই আপনজন। মেয়েটির মা আমার ছোটবোনের মতোই। দেশ থেকে রওয়ানা হওয়ার আগে সে এসে আমাকে তার মেয়েকে দেখে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেছে। আমি যে অস্ট্রেলিয়ার ফোন নম্বরটি ব্যবহার করছি সেটিও ওই বোনের ছেলে বাবুর অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে নিয়ে আমাকে দেয়া। অতএব, দূরত্ব যতই হোক, ভাগিনী তাবাসসুমকে না দেখে অস্ট্রেলিয়া ছাড়ার সুযোগ নেই।

এবার যেনো আমার ক্ষুধা চনমন করে উঠলো। ফয়সাল একটি পেট্রোল পাম্পে থামলেন। এখানেও ইউরোপ আমেরিকার মতো পেট্রোল পাম্পেই চমৎকার সব খাওয়া দাওয়ার আয়োজন, তকতকে ওয়াশরুম। তৈরি পোষাক থেকে শুরু করে স্যুভেনির পর্যন্ত নানা কিছুর পসরা থাকে। ফয়সাল আমাকে একটি স্যান্ডউইচ দিয়ে নিজে অন্য একটি খাবার নিলেন। নিজের জন্য নিলেন বেশ বড়সড় এক মগ স্প্রাইট। আমি একটি কোল্ড কফি নিলাম, লার্জ সাইজ। বহুভাবে জোর করেও বিল আমি দিতে পারলাম না, ফয়সালই মোবাইল টিপে পরিশোধ করে দিলেন।

আমরা আবারো চলতে শুরু করেছি। নখের পিঠের মতো রাস্তা। ৮ লেনের। ফয়সাল যে পড়ন্ত দুপুরে গিয়ে রাতে আবার ফিরে আসার কথা দৃঢ়তার সাথে বললেন, সেটির কারণ বুঝতে পারলাম। প্রচুর গাড়ি, দারুণ স্পিডে চলছে।

কিছুপথ আসার পর ট্রাফিক সাইনে দেখলামব্রিজবেন। আমি চমকে উঠলাম। ব্রিজবেনের নাম প্রচুর শুনেছি,গল্পও। আমি ফয়সালের কাছে ব্রিজবেন এই পথে কিনা জানতে চাইলাম। ফয়সাল বললেন, জ্বী, আমরা ব্রিজবেন শহরের উপর দিয়েই যাবো। ফয়সালকে অনুরোধ করলাম, শহরটির ভিতরে একটু চক্কর দিয়ে যেতে। যাতে আমার ব্রিজবেনও দেখা হয়ে যায়। ফয়সাল বললেন, ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরিয়ে নিয়ে যাবেন।

আমি এতো খুশী হলাম যে, ভাগিনী তাবাসসুমকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। সে যদি এভাবে জোর না করতো তাহলে আমার সানসাইন কোস্টে যাওয়া হতো না। মিস হয়ে যেতো ব্রিজবেনও।

আমরা ব্রিজবেন শহরে পৌঁছে গেলাম। অনন্য সুন্দর একটি শহর। রাস্তার পাশেই বড় বড় হরফে দারুণ করে লেখা ব্রিজবেন। ছবি তোলার স্পট। রাতে নাকি বেশী সুন্দর লাগে। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তাই তখনি ছবি তুলে ফেললাম। ফয়সাল আমাকে স্টেডিয়ামসহ আরো কয়েকটি পয়েন্ট ঘুরিয়ে দেখালেন। শহরের স্কাইলাইন, ব্রিজ, নদীর ধার আর শহুরে ব্যস্ততা মিলে দারুণ একটি শহর দেখার সুযোগ পেলাম। ফয়সাল জানালেন, খুবই বিখ্যাত একটি যাদুঘর আছে এখানে। কিন্তু যাদুঘর দেখার মতো সময় হাতে নেই। যাদুঘরের সামনে দিয়ে ঘুরে আমরা ব্রিজবেন থেকে সানসাইন কোস্টের পথ ধরলাম।

ব্রিসবেন শহর পেছনে ফেলে গাড়ি উঠল ব্রুস হাইওয়েতে। রাস্তার অবস্থা ভালো। লেনের সংখ্যাও মনে হয় কিছুটা কমে এসেছে। গুনে দেখলাম, ৬ লেন। গাড়ির সংখ্যা কম, তবে প্রচুর বেগে ছুটছে। স্পিডলিমিট ১০০ কি.মি। ফয়সাল অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটছেন।

শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর চোখের সামনে খুলে গেল সবুজের চাদর, চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ, যেনো অসীম এক সবুজের রাজ্যে এসে পড়েছি। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ, কোথাও ইউক্যালিপটাস, কোথাও খোলা তৃণভূমি। আমি ফ্রন্ট সিটে বসে যতটুকু দেখা যায় সবটুকুই দেখার চেষ্টা করছিলাম। পাহাড়ি ঢাল আর গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যাস্তের কনে দেখা আলো আমাদের পথ চলাকে বাড়তি আরাম দিচ্ছিলো। রাস্তা কী করে এতো সুন্দর রাখা যায়, কী করে এমন মসৃন হয়!!

ফয়সাল বললেন, আংকেল, গাড়িতে তেল ভরতে হবে। আপনি চাইলে আরেকটা কফি নিতে পারেন। আমিও নেবো।

কফির ব্যাপারে জীবনে কোনদিন আপত্তি করিনি, করবো বলেও মনে হয় না। আমি সায় দিলাম। ফয়সাল বামে ইন্ডিকেটর দিয়ে একটি পেট্রোল পাম্পে ঢুকলেন। আমি বললাম, ফুল ট্যাংক ফুয়েল নিয়ে নিন। ফয়সাল মাথা নাড়লেন। তেল নেয়ার সময় নিজেকেই নিতে হয়। ফয়সাল কি কি টেপাটেপি করে নিজেই ফুয়েল ডিসপেন্সার থেকে তেল নিলেন। পরে গাড়ি সাইড করে বললেন, আংকেল চলেন, কফি নিই। তেলের দামটি দেয়ার জন্য আমি খুব জোর করেও সফল হলাম না। তিনি বললেন, পেমেন্ট হয়ে গেছে। একইভাবে কফির দাম দিতে গিয়েও ফয়সালের জোরাজুরিতে আমি অসহায় বোধ করলাম। ফয়সাল বললেন, আংকেল, চিটাগাং বেড়াতে গেলে সব খরচ আপনার। এখানে আমরা আছি তো।

আহারে জীবন, পৃথিবীর দেশে দেশে এভাবে কতজনের কত ভালোবাসা যে পেয়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। কানাকড়ি খরচ না করে ইউরোপ আমেরিকা সফরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আমার এই ছোট্ট জীবন।

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। রাস্তার দু’পাশের লাইটের পাশাপাশি দূরপাহাড়েও জ্বলে উঠেছে আলো। আমাদের গাড়ি নেমে এসেছে মারুচিডর আর মুলুলাবার পথে। হাইওয়ে ছেড়ে উপকূলের দিকে মোড় নিতেই বাতাসের দাপট যেনো বেড়ে গেলো। ফয়সাল বললেন, কাছেই মহাসাগর, তাই বাতাসের এমন তোড়জোড়।

গাড়ি চলছে। রাস্তার পাশে কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও পার্ক। আলোকোজ্জ্বল বাড়িঘরও চোখে পড়লো। ফয়সাল বললেন, আমরা সানসাইন কোস্টে পৌঁছে গেছি। দশ মিনিটের মধ্যে আপুর বাসায় পৌঁছে যাবো। ফয়সাল বললেন, আংকেল, সানসাইন কোস্টে শুধু অস্ট্রেলিয়ারই নয়, দুনিয়ার অন্যতম সেরা বিচগুলো রয়েছে। তিনি আফসোসের সুরে বললেন, কিছুই দেখলেন না, আংকেল। যদি দুইটি দিনও সানসাইন কোস্টে থাকতেন তাহলে আপনার মন জীবনের জন্য ভরে যেতো! (চলবে)

লেখক: চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা’কে যেমন দেখেছি
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা ও জাতির অগস্ত্য যাত্রা