‘আমি অকৃতী অধম বলেওতো কিছু কম করে মোরে দাওনি,
যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েওতো কিছু নাওনি।’
―রজনীকান্ত সেন
হুমায়ুন আজাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত আমি কোনোদিন আত্মজীবনী লিখবো না। কারণ আমার আত্মজীবনী পড়লে চারপাশ কেঁপে উঠবে।’ হাসনাত আবদুল হাই তাঁর ‘আত্মজীবনীর বিস্তারিত পথ’ শীর্ষক লেখায় বলেছিলেন, ‘আত্মজীবনীতে একজন মানুষের জীবনের সব অভিজ্ঞতা আসার কথা থাকলেও আমরা জানি প্রকৃতপক্ষে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত অব্যক্ত থেকে যায়। যেমন– যৌনতা। যৌন অনুভূতি যখন কৈশোরে জাগে, তা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বা হয় না অথবা সেসময়ে তার দ্বারা সে কীভাবে চালিত হয়, জীবনে তার প্রভাব–এ সমস্ত অনেকেই তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে আনেন না। দাম্পত্য জীবন বিষয়ে কেউ কেউ বলতে চান না। তারপর ধরা যাক, খুব কম লোকই আছেন, যাঁরা মিথ্যা কথা বলেন না বা অন্যায় বা বেআইনি কাজ করেননি। অথচ তেমন উল্লেখ সাধারণত আত্মজীবনীতে আমরা দেখি না অথবা খুব কম আসে।’ আত্মজীবনীর গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে লেখক তাঁর সময়কালের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সমাজ ও রাজনীতির চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেন। বলা যেতে পারে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে কাজ করে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। হাসনাত আবদুল হাই বলেন, ‘আত্মজীবনী যদিও একজন মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত পর্যায়ের ঘটনার বিবরণ এবং সেইসব ঘটনা তার মনে কী রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে এর বহিঃপ্রকাশ, তবু তাতে একজন মানুষের কেবল জীবন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের উল্লেখই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে যে সময়ের মধ্য দিয়ে সে যাচ্ছে, সেই সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে অথবা অর্থনৈতিক যে পরিবর্তন আসছে– সেসবের উপস্থিতিও প্রয়োজন। তা না হলে কোনো আত্মজীবনীকে ‘সম্পূর্ণ’ বলা যাবে না। আত্মজীবনীর ভেতর একজন মানুষকে আমরা যতটা সম্ভব সম্পূর্ণ করে দেখতে চাই।’ অনেকগুলো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমি পড়েছি। এ ধরনের গ্রন্থের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। চেষ্টা করি সংগ্রহ করতে এবং পাঠ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে।
সম্প্রতি প্রকাশিত হলো অভীক ওসমানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমি অকৃতী অধম’। অভীক ওসমান আমার অগ্রজ মেধাবী লেখক। দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে চিনি। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, গবেষণা, সাহিত্য সমালোচনা– প্রতিটি শাখায় তিনি রেখে চলেছেন মেধার স্বাক্ষর। শিল্পসাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, চট্টগ্রাম–উন্নয়ন–সব ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণালব্ধ রচনায় আমরা প্রীত ও ঋদ্ধ। ভাষা, শিক্ষা ও সাহিত্য–বিষয়ক প্রবন্ধ রচনাতেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, তাঁর বিচরণ সর্বমুখী। চমৎকার গদ্যশৈলী ও মেদবর্জিত লেখনীর মাধ্যমে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির উদার বিশ্লেষণের পথ ধরে তাঁর প্রবন্ধ এগিয়ে চলে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নাট্যকারদেরও মধ্যেও তিনি অন্যতম। তাঁর ‘অবশেষে জেনারেল’ পথনাটক নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ কাঁপিয়েছে।
সমকালীন বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ তাঁর রয়েছে, ফলে নানা সময়ে আমরা তাঁর কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছি অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা। আমাদেরই চাপে বা নিরন্তর তাগাদায় তাঁর অনেক লেখা রচিত হয়েছে। কেননা আমি জানি, যে কোনো কঠিন ও সামপ্রতিক বিষয়ে সুন্দর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অভীক ওসমান অতুলনীয়।
তাঁর পেশাগত জীবন কেটেছে শতোর্ধ ট্রেডবডি চিটাগাং চেম্বার সচিবালয়ে। এর সচিব ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে বোর্ড অব ডাইরেক্টার্সের নেতৃত্বে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণ, সিআইটিএফ আয়োজন, ক্ষুদ্র মাঝারী ও মহিলা শিল্প উদ্যোক্তাদের বিকাশে ভূমিকা পালন করেন তিনি। গদ্য গবেষণা–মুক্তিযুদ্ধ–মনীষীদের জীবন ও কর্ম সম্পাদনা, নাটক, কবিতা নিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২০। আলোচ্য গ্রন্থটি ছাড়া অন্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : অবশেষে জেনারেল (১৯৮৮)-নাটক, শংখ উপখ্যান (১৯৮৯)-নাটক, গদ্যকথা (১৯৯৩)-প্রবন্ধ, বিষাদের জার্নাল (১৯৯৫)-কাব্যগ্রন্থ, অভীক ওসমানের তিন নাটক (২০০১), পৃথিবীর করুণ ডাঙায় (২০০৫)-প্রবন্ধ, প্রয়াত পাঁচ ও ইবসেন (২০০৭)-প্রবন্ধ, শুধু তোমার জন্যে এই অরণ্যে (২০১২)-কাব্যগ্রন্থ, হে সংসার হে লতা (২০১৬)-কাব্যগ্রন্থ, নাট্য চতুষ্টয় (২০১৭)- নাটক, গুরুদক্ষিণা (২০১৯) জীবন–স্মৃতিগদ্য। গবেষণা ও সম্পাদনা গ্রন্থ: চির উন্নত শির (১৯৯৯), মোতাহের হোসেন চৌধুরীর অপ্রকাশিত গান ও কবিতা (২০০২), মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর অপ্রকাশিত ‘হতাশ জীবন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ (২০০৯)। শহীদ মেজর নাজমুল হক : সেক্টর ৭ এর বিস্মৃত কমান্ডার’র উপাখ্যান।
অভীক ওসমান গ্রাম থেকে উঠে আসা এক নাগরিক। গ্রামে শৈশব কটেছে তাঁর। তাই এখনো স্মৃতিকাতর হন তিনি। শৈশব লাফিয়ে উঠেছে সরপুঁটির মতো, খেলা করে তাঁর বুকের ভেতর। সবুজ বিল, ধান ভরা মাঠ, সবুজ ঘাস–তার পাশে বয়ে চলা শঙ্খ নদী এখনো নেচে ওঠে স্মৃতির জানালা ধরে। পদে পদে বাধা অতিক্রম করা ‘জীবন–সংগ্রামী’ হিসেবে আমরা দেখেছি তাঁকে। তাঁর পুরো জীবন উঠে এসেছে ‘আমি অকৃতী অধম’ গ্রন্থে। গ্রন্থটি একটি মহার্ঘ কাজ। এতে রয়েছে ৫৬টি অধ্যায়। সবশেষে আছে ‘পাঠকের জন্য খোলা চিঠি’।
জীবনের নানা পর্যায়ে দায়িত্বশীল পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন সাবলীল ভাষায়। ড. ইউসুফ ইকবাল লিখেছেন, ‘সংগ্রাম মিশে আছে তাঁর জীবনের বিবিধ প্রান্তে। সে–সংগ্রাম ব্যক্তিগত সীমানা অতিক্রম করে স্পর্শ করেছে জাতীয় জীবনের পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রেণিহীন, শোষণহীন একটি মানবিক কল্যাণকামী সমাজ অন্বেষণের তিনি অগ্রসৈনিক। পুরো যৌবন তিনি নিবেদন করেছেন দেশমাতৃকার প্রেমে–সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের সংগ্রামে। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, বৈষম্যহীন একটি সমাজকাঠামো, যেখানে মানুষ বিকশিত হবে নিজের ইচ্ছায়– স্বাধীনভাবে। জীবনের বর্তমানপ্রান্তে এসে এখনও তিনি লালন করেন অভিন্ন বিশ্বাস।’
লেখালেখিকে তিনি নিয়েছেন জীবনের অনিবার্য অবলম্বন হিসেবে। নিজেই বলছেন: ‘আমার জীবন ও কর্মের প্রতিফলন, আমার জীবনের সংগ্রাম, আমার বিশ্বাস এবং আমার ইমোশনকে রিফ্লেক্ট করেছি আমার নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ এবং নিখিল লেখালিখিতে।’
অভীক ওসমান একজন আবেগী স্বাপ্নিক মানুষ, তবে সফল কর্মযোদ্ধা। জীবনশিল্পী। জীবনকে উপভোগ করেছেন। তাই মনে হয় তাঁর জীবন কর্মের বিরতিহীন অধ্যায়। কখনো বিরতি থাকলেও গতিহারা হননি। হয়তো এখন তাঁর যাত্রা শুরু, আবার থামলেন, এই যাত্রা, আবার থামলেন, আবার যাত্রা আবার বিশ্রাম–এই হলো তাঁর জীবন। ‘আমি অকৃতী অধম’ গ্রন্থের প্রকাশক ঐতিহ্য, ঢাকা। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য রাখা হয়েছে আটশত টাকা।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো, বাংলা একাডেমি।












