স্থবির শিল্প বিনিয়োগ : চ্যালেঞ্জের মুখে অর্থনীতি

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা হতাশ, বিক্ষুব্ধ। লাগামহীন ডলারের দর সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। উচ্চ সুদের হার কমেনি। পতনে পতনে বিপর্যস্ত পুঁজিবাজার। রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে মূল্যস্ফীতি। ব্যবসাউদ্যোগের জন্য চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে না ঋণ। স্থবিরবিনিয়োগ কর্মসংস্থান। আসছে না শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি। বেচাবিক্রিতে মন্দা। একে একে বন্ধ হচ্ছে ব্যবসাশিল্প কারখানা। খুনখারাবিমব থামেনি। দেশে ফেরেনি নিরাপত্তা। চাকরি হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। বাড়ছে বেকারত্ব। বকেয়া পড়ছে বেতন ভাতা। রপ্তানিও কমছে উদ্বেগজনক হারে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলা শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পরও উৎপাদনে যেতে পারছে না। উৎপাদনে যেতে না পারার কারণে বিনিয়োগকারি কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ বিদেশী বিনিয়োগকারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। দেশে ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুাতিক গাড়ির চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানবৈদ্যুতিক গাড়ির কারখানা তৈরির কাজ শুরু করে চট্টগ্রামের জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এনএসইজেডে, ১০০ একর জায়গায় ২০২২ সালে এ কারখানার কাজ শুরু হয়েছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠানটি জুন ২০২৫ এ তাদের নির্মাণ কাজ শেষ করে। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না পাওয়াতে উৎপাদনে যেতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। কেইপিজেড (কোরিয়ান ইপিজেড) ২০১১ সালে সরকার প্রথম বেসরকারি ইপিজেড হিসেবে অনুমোদন লাভ করে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় প্রতিষ্ঠিত ২৪৯২ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আধুনিক পরিবেশ বান্ধব এবং আধুনিক শিল্প শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠিত কোরিয়ান ইপিজেড দেশের শীর্ষস্থানীয় এবং সব্র্‌াচে্চ বিদেশী বিনিয়োগকারি প্রতিষ্ঠান ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগকারীদের জন্য কেইপিজেডে (কোরিয়ান ইপিজেড) বিশেষ আর্থিক ও অরাজস্ব সুবিধা এবং দ্রুত প্রশাসনিক অনুমোদনের অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। ৭০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক বিনিয়োগে এখানে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প উদ্যোক্তা এবং চেয়ারম্যান মিঃ কিহাক সাং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ছোট আকারের পোশাক শিল্পের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ইপিজেড চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এখানে প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সরকার মিঃ কিহাক সাংকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নাগরিকত্ব প্রদান করেছেন। কিন্তু সরকারের এত কিছু সুবিধা উদ্যোগের সফলতা ম্লান হয়ে যায় যখন তার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তম ইপিজেডে স্থাপিত কারখানাগুলো গ্যাসের অভাবে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়।

কোরিয়ান ইপিজেডে স্থাপিত আমেরিকার বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত মেসার্স আমেরিকান এন্ড এফিয়ার্ড (বাংলাদেশ) লিমিটেড বছরের অধিক সময় আগে আবেদন করেও গ্যাস সংযোগ পাইনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বার বার আবেদন করেও শিল্প সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রথম ইপিজেড চট্টগ্রামের সিইপিজেডে প্রতিষ্ঠিত মেসার্স বিডি এ্যাপারেলস্‌ লিঃ দুই বছরের অধিককাল ধরে ছোট একটি বয়লারে গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করেও সংযোগ পায়নি। গ্যাস সংযোগ না পাওয়াতে বিদেশি বায়ার তাদের অর্ডার ক্যানসেল করে দিয়েছে। এভাবে চট্টগ্রামের অনেক আবেদনকারি উদ্যোক্তা গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করে সংযোগ পাচ্ছে না। অথচ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পক্ষ হতে সর্বশেষ নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান ও লোড বৃদ্ধিকরণ বিষয়ে ২৫ জুলাই ২০২৫ ইং তারিখে এক পরিপত্র জারি করে। ‘সেখানে বলা হয়েছে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান ও লোড বৃদ্ধিকরণ সংক্রান্ত বিষয়ে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত সূত্রোক্ত পত্র সমূহ একীভূত করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে আংশিক সংশোধনক্রমে নিম্নরূপ নিদের্শণা সমূহ প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে এ পরিপত্র জারি করা হলো।’ ‘নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে শিল্প, বিদ্যুৎ ও সারকারখানাকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে—-সরকার নির্ধারিত শিল্পাঞ্চল, ইপিজেড এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে গ্যাস সংযোগের বিষয়কে অগ্রাাধিকার দিতে হবে।’ কিন্তু দুর্ভাগ্য আামদের এবং উদ্যোক্তাদের, বার বার পরিপত্র জারি হয় ঠিকই কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিনিয়োগকারিরা ধুকে ধুকে মরে। বর্তমান দেশের প্রায় ৩০% শতাংশের অধিক শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদনে যেতে পারছেরা অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে ধাক্কা লাগছে রাজস্বে। রেমিট্যান্স ছাড়া প্রায় সব সূচকই ভঙ্গুর অবস্থায়। বলা যায়, অনেকটা পিচ্ছিল পথেই চলছে দেশের অর্থনীতি। ব্যবসায়ীদের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, দেশের শীর্ষ গ্রুপ ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে জীবনেও যাঁদের কখনোই খেলাপির রেকর্ড নেই, তাঁদের কপালেও আজ ঋণখেলাপির তিলক। ছোটবড় সব স্তরের শিল্পগ্রুপগুলো টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। চাকা যেন আর চলছে না! এমনই চিত্র এখন দেশের অর্থনীতিতে। অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া যায়।

জ্বালানি তথা জ্বালানি নিরাপত্তার ঘাটতি, অর্থাৎ যে কোনো মৌলিক চাহিদার (অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা বাসস্থান) ঘাটতি যতটা না বিপজ্জনক এর থেকেও জ্বালানি ঘাটতি অত্যাধিক ভয়াবহ বিপদজ্জনক। তাই এ ঘাটতি সৃষ্টি করা সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল।

সুতরাং দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যায্য ও যৌক্তিক মূল্যে এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। ব্যবসায়ীরা এই সরকারের কাছ থেকে এখনো এমন কোনো আশা জাগানিয়া বার্তা পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে ্‌এমন কোনো পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে তাঁরা মনে করতে পারেন যে তারা সন্তুষ্ট, খুশি, তৃপ্ত। বরং কখনো কখনো তাদের টুঁটি চেপে ধরার মতো অবস্থাও তৈরি হয়েছে। আগের সরকারের স্বৈরাচারি মনোভাব, ঘুষদুর্নীতি, ভুল নীতির কারণে যেমন একটি পরিবর্তনের প্রত্যাশা জেগেছিল; গণঅভ্যুত্থানে অনেক ত্যাগের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিল, তাদের সময়ও পরিস্থিতি অনেকটা এমনই।

ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বলে আসছেন, তারা রীতিমতো সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার। গত ১৪ মাসে এমন কোনো ফোরাম বা সম্মেলনের কথা শোনা যায়নি, যার মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়ী সমাজকে ডেকে সরকার তাদের সমস্যা, সংকট ও চ্যালেঞ্জের কথা শুনবে।

দেশের অর্থনীতি সংকটময় পরিস্থিতি পার করেছে। কোনোভাবেই এতে স্বস্তি ফেরানো যাচ্ছে না। বিনিয়োগ স্থবিরতা, বেকারত্ব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার, রপ্তানি রাজস্বের মন্দা, অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছে। আস্থাহীনতা অর্থনীতির গতিকে আরো মন্থর করে দিয়েছে। সরকারের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে অর্থনীতির নানা দূর্বলতার কথা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের(জিইভি) অক্টোবর মাসের ইকোনমিক আপডেট বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

ব্যাংকগুলোতে ঋণ বিতরণে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সরকারের উর্ধ্বতন মহলে এ বিষয়ে অস্থিরতা লক্ষ্যণীয়। কমিটির পর কমিটি গঠন করা হচ্ছে মাসের পর মাস অতিবাহিত হচ্ছে কিন্তু কার্যকর কোন ফলাফল উদ্যোক্তারা দেখতে পাচ্ছেন না। ফলে বিনিয়োগকারীদের মাঝেও অস্থরিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গ্যাসের অভাবে আমদানীকৃত যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোন আশারবাণী তারা পাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ বিনিয়োগহীন পরিবেশের মধ্যে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞমহল মনে করছেন। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন এ অবস্থা হতে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি সহায়তা ও স্বচ্ছতা থাকলে বিনিয়োগকারীরা আবার সাহস পাবে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সব ভয়ভীতি, আশাঙ্কা ও সংশয় দূর করে নির্বাচন হবেসরকারের এই আশ্বাসেই অবিচল। তারা আশা করতে চান যে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হবে। এতে জনগণের ভোটে একটি রাজনৈতিক দলের সরকার হবে। অন্তর্বর্তী সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের কৃতিত্ব নিয়ে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এর ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলায় আস্থা ফিরেবে। ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারীরাও তাদের ব্যবসা উদ্যোগে পূর্ণোদ্যমে ফিরবেন। সেদিকেই চেয়ে আছে তারা। আমরা চাই দেশে বিনিয়োগ হোক। কারো ইচ্ছের কাছে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে জ্বালানি সেক্টর সম্পূর্ণ দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল। দ্রুত সমাধান জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্ট্রোকের পর ফিজিওথেরাপি কেন অপরিহার্য
পরবর্তী নিবন্ধ‘আমি অকৃতী অধম’ : একটি মহার্ঘ কাজ