জ্বালানি তেল খাতে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা চুরি, সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি ঠেকাতে পুরো বিতরণ ব্যবস্থাকে অটোমেশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘স্মার্ট ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউশন মনিটরিং সিস্টেম (এসএফডিএমএস)’ নামে আধুনিক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা করতে আগামী বুধবার রাজধানীতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। বৈঠকে বিপিসি, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর জ্বালানি তেল পরিবহন ব্যবস্থাকে আধুনিক করার লক্ষ্যে সরকার এই প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে তেল পরিবহন খাতে এই মনিটরিং ব্যবস্থা চালুর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
বিপিসি সূত্র জানায়, ‘স্মার্ট ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউশন মনিটরিং সিস্টেম’ চালু করার মাধ্যমে মাদার ভ্যাসেল থেকে জ্বালানি তেল গ্রহণ থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটি অটোমেশানের আওতায় আনা সম্ভব হলে চুরি, সিস্টেম লস, দুর্নীতিসহ সব ধরনের অপকর্ম পুরোপুরি ঠেকানো যাবে। বিপিসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, তেল পরিবহন ও মজুদের প্রতিটি ধাপে আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হবে। ট্যাংক–লরির নিরাপত্তায় জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম, অয়েল ট্যাংকার মনিটরিংয়ের জন্য গুগল ম্যাপ সমন্বিত অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) এবং বিপিসির স্থাপনাগুলোতে আইপি ক্যামেরা মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। তেল আমদানি, মজুদ ও বিতরণ সংক্রান্ত তথ্য রিয়েল টাইমে দেখতে একটি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ডও তৈরি করা হবে। গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে বিপিসির জন্য পাঁচ ডিজিটের হটলাইন চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বিপণন কোম্পানিগুলোর সব স্থাপনা অটোমেশনের আওতায় আনা, ডিলার ও গ্রাহকদের তথ্যভিত্তিক অ্যাপ তৈরি, ভবিষ্যৎ তেলের চাহিদা নিরূপণ এবং বিকল্প জ্বালানির সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য একটি গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও ডেবিট–ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধের ব্যবস্থাও চালু করা হবে বলে জানিয়েছে বিপিসি।
বিপিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই সিস্টেম চালু করা একটি একক কাজ নয়। একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অটোমেশান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। শুরুতে পরিবহন পর্যায় থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে পুরো বিতরণ ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে অটোমেশনের আওতায় আনব।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আড়াইশ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। নারায়নগঞ্জের পিতলগঞ্জ থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার সরবরাহ পাইপ লাইন নির্মাণের প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা প্রকল্পটি নতুন করে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই পাইপ লাইনে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানের জ্বালানি সরবরাহ দেয়া হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে অয়েল ট্যাংকারে গুদনাইল এবং সেখান থেকে পিতলগঞ্জ হয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে শত শত ট্যাংক লরির মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহ দেয়া হয়। এই রুটে কোটি কোটি টাকার তেল লোপাটের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অটোমেশনের অংশ হিসেবে পাইপ লাইনটি চালু হলে এই রুটে চলে আসা অনিয়ম পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হবে বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবছর বিপিসি প্রায় ৭৩ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এরপর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির কাছে বাকিতে বিক্রি করে। কিন্তু বছরের শেষে দেখা যায়–তিনটি বিপণন কোম্পানি কোটি কোটি টাকার মুনাফা করলেও বিপিসি মোটা অংকের লোকসান দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি তেল খাতে স্বচ্ছতা ও রিয়েল টাইম মনিটরিংয়ের অভাবেই বিপিসিকে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে। শুধুমাত্র অটোমেশনের অভাবে চুরি এবং সিস্টেম লসের সুযোগে বিপুল পরিমাণ তেল লোপাট হওয়া এবং হিসেবের গোলমালের কারণে লোকসানের অংক বাড়তে থাকে। অটোমেশন সম্পন্ন হলে পুরো সেক্টরে সুষ্ঠু একটি ধারা তৈরি হবে। বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, প্রথম ধাপে চট্টগ্রামের পতেঙ্গাস্থ প্রধান তেল স্থাপনাগুলো অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। এরপর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের ডিপোতেও একই ব্যবস্থা চালু করা হবে।
অটোমেশন সম্পন্ন হলে মাদার ভ্যাসেল থেকে প্রধান স্থাপনায় তেল গ্রহণ, তেল প্রধান স্থাপনার ট্যাংকে পৌঁছানোসহ তেল গ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপই কম্পিউটারাইজড নিয়ন্ত্রিত হবে। পরবর্তীতে ওই তেল ট্যাংক থেকে পাইপযোগে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী তেলবাহী অয়েল ট্যাংকার, তেলের লরি, ট্রেনের ওয়াগনসহ যেকোনো ক্ষেত্রে ডেলিভারি পদ্ধতিও পুরোপুরি কম্পিউটারাইজড হবে। অটোমেশনের ফলে বিপিসি কিংবা তেল কোম্পানিগুলোর মূল অফিস থেকে সার্বক্ষণিক আপডেট রিপোর্ট দেখা যাবে। এমনকি তেল গ্রহণ ও ডেলিভারি কার্যক্রমের পুরো বিষয়গুলো সচিত্র দেখা যাবে বলেও বিপিসির সংশ্লিষ্ট একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে জানান। তিনি বলেন, আগামী বুধবার পুরো বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। সরকার এই প্রকল্পের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক বলে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা জানান, জ্বালানি তেল সেক্টরের সব অনিয়মই এই একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঠেকানো যাবে।












