চুপ থেকে সুখে থাকা যায়?

যৌন হয়রানির শিকার ৯৬ শতাংশ নারীই আইনি পদক্ষেপ নেন না

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

ছোটবেলায় খুব আফসোস হতো, সবার মা স্কুলে আসেন কিন্তু আমার মা আসেন না কেন? খুঁটিয়ে দেখি আমাদের আট ভাইবোনের কারো বেলাতেই এই আইন ভাঙ্গেনি ফলে আম্মার আর প্রয়োজন হয়নি কোনো নতুন রাস্তা চেনার। সময়ের সাথে স্কুলের কার্যক্রম কিংবা ব্যক্তিগত দায়িত্ব নেওয়ার কাজটুকু নিবিড় যত্নে নিজেই সেরেছি। কখনো প্রয়োজনে, কখনো অনীহায়। পাশে ভাইবোনেরা সাহস আর পথ দিয়েছে। ফলে প্রতিবাদের অন্ধকার রাস্তায় হাঁটার অভ্যাস নিজেকে বের করতে হয়েছে। এ গল্প বোধহয় অনেকেরই, নতুন কিছু নেই। অন্য একটি গল্প বলি?

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন, সে স্কুলেই সপ্তম থেকে দশম পাস। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কিন্তু সমস্ত পন্ডিতি করতেন প্রধান শিক্ষক কাম চেয়ারম্যান স্যার। তো, পুরো স্কুল হোস্টেলে প্রায় একশ ছেলের ভীড়ে একটাই ছাত্রী শিক্ষিকা সমেত থাকতো। কিছুদিন যেতেই সে আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। জানতে পারি, সে সম্মানতুল্য শিক্ষক তাকে অনেকবার যৌন হয়রানি করেছে। প্রথমে ছোটখাট কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। একদিন সে শিক্ষক ক্লাস ভর্তি ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে আমার সাথেই এমন করে বসেন। সেদিন দ্রুত গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলাম গণস্বাক্ষর নিয়ে। আফসোস যেদিন বিচারে ডাকা হলো কেউ আমার পাশে ছিল না। শিক্ষকেরা বারবার সম্মানের দোহাই দিয়ে রফাদফা করলেন। এসব গল্পও খুব পুরানো হয়ে গেছে, তাই না?

শেষ গুগল সার্চে দেখি, মাগুরায় প্রধান শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার একাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছে। ক্লিনিকে রোগীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। বুয়েটের শিক্ষার্থীর দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার একাধিক নারী এমন একশত হাজার নিউজ এখনই বের করে আনা সম্ভব কিন্তু এত এত অভিযোগে আইনি সুরাহা বা ন্যায্য বিচারের নিউজ হাতেগোনা কয়টা দেখাতে পারব আমরা? উপরে উল্লেখিত দুএকটা নিউজ সামনে এসেছে কারণ অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে তাই। কিন্তু এমন কত শত ঘটনা রোজ পড়ে থাকে আমাদের অন্ধকার গলিতে।

এত শব্দ ব্যয়, মানসিক চাপ না নিলেই হতো। কিন্তু একজনের প্রাণ চলে গেলো। সমস্ত মিডিয়া পাড়ায় এখন একটাই নিউজ গণমাধ্যম কর্মী স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যা। গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর নিজ গৃহে স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। নেপথ্যে জানা যায়, তার তীব্র মাইগ্রেনের সমস্যা ছিল, পারিবারিক সমস্যার পাশাপাশি একটি কাগজ সবাইকে আবারো ভাবতে বাধ্য করে, কি হয়েছিলো স্বর্ণময়ীর সাথে?

গত ১৩ জুলাই, নব্য জন্ম নেওয়া মিডিয়া ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা বিভাগের প্রধান ও অন্যতম শেয়ার হোল্ডার আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে নারী কর্মীরা স্বাক্ষর সমেত একটি অভিযোগপত্র জমা দেন। তাতে ৮ টি অভিযোগের অন্যতম অভিযোগ হলো, আলতাফ শাহনেওয়াজ নারীদের ভার্বাল এবিউসিভ কথা বলতো। ব্যক্তিগত যৌন গল্প শুনতে চাইতো, রাতবিরাতে ফোনসহ নানাবিধ হয়রানি করতো। মূলত স্বর্ণময়ী বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছিলো তার অফিসে। সেখানে শিক্ষানবিস গ্রাফিক্স ডিজাইনারের পদে চাকরি ছিল তার। কিন্তু এমন ঘটনায় অভিযোগ পত্রের বিরুদ্ধে ঢাকা স্ট্রিম জানায়, অভিযোগ সুরাহা হয়েছে আগেই। তবে একাধিক নারীকর্মী নিশ্চিত করেছে অনেকের চাকরি নেয়া এবং আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষে আসতে বারণ করা এবং অফিসে আচরণবিধি প্রণয়ন ছাড়া আর তেমন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। যদিও স্বর্ণময়ীর মানসম্মান রক্ষার্থেই তার পরিবারকে বিষয়টা মিটমাট করে নিতে বলেন ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান।

স্বর্ণময়ীর আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, আলতাফ স্বর্ণময়ীকে মারাত্মক ভার্বাল এবিউজ করতো। তার ভাষা এমন কেন এবং আচরণ সংক্রান্ত বিষয়ে অসংখ্যবার উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছিল স্বর্ণময়ী। তার(আলতাফ শাহনেওয়াজ) ভাষা ছিল এমন, যার ব্রেস্টের সাইজ ভচকানো তার বাংলা তো ভচকানো হবেই!

হ্যাঁ, মারাত্মক ভার্বাল এবিউজ। এখন আমরা বিষয়টাকে হালকা করে নিতেই পারি কেননা ভার্বাল এবিউজ আদতে কোনো এবিউজই না। রেইপ হলে একটা বিষয়! স্বর্ণময়ীদের মরিয়াই কেন প্রমাণ করতে হয় আলতাফদের মত মানুষেরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র এবং এর নেপথ্যে দীর্ঘদিনের কালচার দায়ী। স্বর্ণময়ীর একমাত্র দাদার দাবি, এই ভার্বাল এবিউজ একটি উৎসেচক হতে পারে তবে এটাই প্রধান কারণ এমন নয়। কিন্তু স্বর্ণময়ী যদি আত্মহত্যা না করতো তাহলে কি আমরা আলতাফদের কথা জানতাম না?

মিডিয়া পাড়ায় খুব কম গুনী সাহিত্যিক, কবি, লেখক কিংবা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আছেন যারা বলবেন না, অভিযুক্তের চারিত্রিক সমস্যা আছে। প্রশ্ন করা যায়, এধরণের তথ্য সুনিশ্চিতভাবে থাকার পরেও একজন মানুষ এতটা দূর কিভাবে এলেন? তার আওতায় কতশত নারীকর্মী ছিলেন? স্বর্ণময়ী আত্মহত্যা না করা অব্দি কেন কেউ এসব বিষয়ে কথা বললেন না। জনসমুদ্রে গা ভাসিয়ে কেন তোষামোদী করলেন। দিনে দিনে যেকোনো ধরণের এবিউজই যেভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সেখানে সামান্য সন্দেহ জাগ্রত হলে তার সুষ্ঠ তদন্ত তো করাই যেত। বরং বিশাল মিডিয়া হাউজে এধরনের এবিউজই নাকি নরমাল, শুধু মিডিয়া না অনেক অফিসেই অসংখ্য নারীকে এবিউজের শিকার হতে হয়। এমনটা জানিয়ে ফেইসবুকে লিখছেন কর্মজীবী নারীরা। অর্থাৎ এটা কালচার। আমরা যৌন হয়রানিকে একটি কালাচারে পরিণত করেছি। যেমন পরিণত করেছিলাম অসংখ্য নারীবিদ্বেষী গালিকে। যদিও অনেক সাহিত্যিকই মনে করেন, গালি নাকি আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে, শুধু রাগ নয় অনেক সময়ে ব্যঙ্গ রসাত্মকভাবেই নাকি গালির ব্যবহার রয়েছে। ঠিক হবে হয়তো, আমরা ধরে নিতে পারি একজন নারীর স্তনের আকারআকৃতি দিয়ে তার বাংলা মাপা যায়, রাতে ফোন করে বিরক্ত করা যায়, অনিচ্ছার পরেও গায়ে হাত দেওয়া যায় আর অতি উৎসাহে ধর্ষণও করা যায়। এসবকিছুই আমাদের কালচার।

কালচারের কথা যদি আরেকটু বলি, দীর্ঘদিন এসবের ভয়ে, এধরণের হয়রানির চিন্তায় ভিন্ন কোনো কর্মসংস্থান খোঁজা হয়নি অনেকের। রাস্তায় রেইপের ভয়ে এখন সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফেরাকেই আধুনিক সমাজ হিসেবে দেখছেন অনেকে। যেমন স্বয়ং আমারই কোনো ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার ভয় কাজ করে, পুরুষ সম্পাদক কিংবা পুরুষ বসের কথাও ভাবতে ইচ্ছা করে না। একজন সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীর পক্ষে এভাবে গুমোট ঘরে কমিউনিকেশন সেক্টরেও কতখানি কাজ করা সম্ভব জানি না। যেখানে বারংবার প্রতিবাদের ধ্বনিতে আমাদের হুংকার দেওয়ার কথা তখন ফেইসবুকে জানাচ্ছি, ভাই সব অফিসেই হয়। চলেন সব অফিসের মানুষগুলোকে আগে ধরি। একসাথে এত মাছ তো ধরা সম্ভব নয় আর রাঘব হলে তো কথাই নেই। ফলে আমাদের আইনের জাল থেকে পালিয়ে যায়। জেনারাইলেশনের এ যুগে কিছুদিন পর এ আই দিয়ে তৈরি হতে পারে স্বর্ণময়ীর চরিত্র হরণ। এছাড়া আর কিছু দেখছি না।

পত্রিকার হেডলাইনে প্রায় আসে, প্রতি চারজনের তিনজন নারীই যৌন হয়রানির শিকার। কিন্তু কতজন নারী এই অভিযোগে আইনি পদক্ষেপ নেন? ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, যৌন হয়রানির শিকার ৯৩ শতাংশ নারীই কোনো আইনি পদক্ষেপ নেন না। এবং এর অন্যতম কারণ সঠিক উপায়ে হয় তারা অভিযোগ জানান না কিংবা অভিযোগের পর তাদের উলটো হয়রানি করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মোতাবেক, একই প্রতিষ্ঠানের অন্তত এগারো জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন নানা মাধ্যমে।

মজার ব্যাপার হলো, ঢাকা স্ট্রিম গত এক সপ্তাহে অন্তত তিনটি নিউজ করে যৌন হয়রানি নিয়ে। যার মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিকার না পাওয়ার সংবাদ। একে বাংলায় বলে, নিজের চরকায় তেল দেওয়া। নিজেদের হাউসের খবরটা যদি দ্রত রিপোর্ট করতো তাহলে অন্তত স্বর্ণময়ীয় এমন পরিণতি নাও হতে পারতো। হ্যাঁ, হতে পারে স্বর্ণময়ীর এই মৃত্যু নিছক আত্মহত্যা, কোনো যৌন হয়রানির ভিত এত শক্ত নয় যে তাকে আঘাত করতে পারবে। কিন্তু যদি সে বেঁচে থাকতো? চুপ করে সুখে থাকা যেত?

কেন নারীরা যৌন হয়রানির অভিযোগ জানাতে চান না? বেশিরভাগ গবেষণা বলছে, উলটো হয়রানির ভয়েই তারা চুপ করে থাকেন। চুপ করে থাকলে যদি সম্মান আর সুখ দুটোই আসে তাহলে প্রত্যেক নারীই সুখী, কোনো ধর্ষণের ঘটনা এই বাংলায় ঘটেনি।

প্রতিনিয়ত, তথাকথিত ‘আলুরদোষ’কে সাধারণীকরণের তীব্র নিন্দা। যেসকল কালচার শুধুই এলিট মজলিশে আপনার সত্তাকে হত্যা করে তাদের প্রতি তীব্র নিন্দা। যেসকল মানুষ যৌন হয়রানির গল্পগুলোকে মসলা মাখিয়ে আড্ডায়, কবিতায় রসিয়ে তুলেন তাদের প্রতি নিন্দা। আর নিন্দা জানানো হবে সেসকল স্বাক্ষরকারীদের প্রতি যারা গণস্বাক্ষরে নিজের নাম দেন কিন্তু কাজের বেলায় ছায়া মাড়ান না। চুপ থেকে তো আর সুখে থাকা যায় না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএখন সময় এসেছে চট্টগ্রাম চেম্বারকে মেরামত করার
পরবর্তী নিবন্ধলায়লা খালিদ: ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক