বর্তমান বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি নীরব ঘাতক হয়ে ধেয়ে আসছে। এটা খুবই আশঙ্কার কথা। যদিও বর্তমান অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতিগত কারণে অনেকাংশে প্রতিকার করা যাচ্ছে। বিশেষ করে হৃদরোগে ইমারজেন্সি আক্রান্ত রোগীদের ৮০% রোগ সফলভাবে আরোগ্য লাভ করছে। যেটা ২৫–৩০ বছর আগে ভাবাও যেতো না। তার সাথে অন্যান্য রোগও আছে। আর সংক্রামক রোগ যেমন কলেরা, ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, বসন্ত, হোম ডেঙ্গু, পোলিও, ম্যালেরিয়া ডিপথেরিয়া, টিটেনাম করোনা প্রভৃতি। কার্যকরি টিকা দেওয়ার ফলে ও স্বাস্থ্য সচেতনতার ফলে প্রকোপ কমে গেছে।
আজকের আলোচনা অসংক্রামক ব্যাধি যেমন হৃদরোগ (সারা বিশ্বে মৃত্যুর প্রধানকারণ)। উচ্চ, রক্তচাপ (নীরব ঘাতক) স্ট্রোক (ব্রেইনের রোগ) ডায়াবেটিস (সারাজীবনের রোগ) ক্রনিক কিডনি রোগ, ক্রনিক লিভার, ডিজিজ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাস কষ্টজনিত রোগ, হাড়ের রোগ–অষ্টি ও পরোসিস, অষ্টিও আরত্রাইটিস, ক্যান্সার (শরীরের যে কোন জায়গায় হতে পারে) দ্রুত রোগ নির্ণয়ে ভালো ফল আনতে পারে। স্নায়ূ রোগ ডিমেনসিয়া (স্মৃতি ভ্রষ্ট) অ্যালজেইমার; মেরুদন্ডের রোগ, থ্যালাসেমিয়া, বয়স্কদের প্রোস্টেটজনিত রোগ, অগ্রাসরের রোগ, কিডনি ফেইলিউর প্রভৃতি। এই ধরনের রোগে আক্রান্ত মানুষের পারিবারিক ও জিনগত ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করবেন ডাক্তারের নিকট গেলে তারা প্রায়শই জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার মা বাবার এই রোগ ছিল বা আছে কিনা। বর্তমান মানুষের গড় আয়ূ বাড়ার সাথে সাথে বাধর্ক্যজনিত রোগ বাড়ছে। তাতে পারিবারিক সামাজিক ও অর্থনীতির উপর চাপ পড়ছে। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘস্থায়ী। কোন কোন রোগের চিকিৎসা আজীবন চালাতে হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ অসংক্রামক ব্যাধি দায়ী। ৮০ শতাংশ মৃত্যু হয় তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে। তাই জনসচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। এই রোগে আক্রান্তের অর্ধেক সংখ্যা কম বয়সীদের যেটা ভয়াবহ। অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব আমাদের মতো নিম্নআয়ের দেশে বেশি। তাতে গরীব, নিম্নবিত্ত ও এমনকি মধ্যবিত্তরাও চিকিৎসা ব্যয় ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই বলবো দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বেড ও ওষুধ সরবরাহ বাড়াতে হবে। ওষুধের দাম নিম্নমুখী রাখতে হবে। তবেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিকিৎসা পাবে। হাসপাতালে ওষুধ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি দমন করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করতে গেলে সচেতনতার সহিত নিয়মগুলি পালন করতে হবে (১) লাইফ–স্টাইল বদলাতে হবে। প্রথমেই বলি শরীরটাত একান্তই আপনার। বাঁচতে হবে আপনাকে। আপনি না থাকলে পরিবার ধ্বংস। আর বাঁচতে গেলে মানতে হবে। কথায় আছে ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সওয়াই তাহা সয়।’ মানুষ অভ্যাসের দাস। আপনি অভ্যাস করে ফেলুন এবং পরিবারের সবাইকে অভ্যাস করান। দেখবেন পুরো পরিবার সুস্থ থাকবেন। ডাক্তারের নিকট যেতে হবে না। অনেক অর্থ বেঁচে যাবে। জীবন ধারনের জন্য একজন লোকের কাড়িকাড়ি টাকার দরকার হয় না। পকেট ভর্তি টাকা কিন্তু আপনি সুস্থ নন, ঐ টাকায় কি হবে। আরও একটা কথা বলি বিলাস বহুল জীবন ক্ষণস্থায়ী। সেখানে প্রাচুর্য আছে, কিন্তু শান্তি নাই। উচ্চবিত্ত এবং ক্ষমতাবান লোকদের কিছু ছেলেপেলে বিপথগামী হয়। অকালে ঝরে পড়ে। সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব আমরা। অজ্ঞতায়, অসচেতনতায় কেন আমরা ভুগবো। আমরা প্রতিক্ষেত্রে সচেতন থাকবো। সব ভালকে অভ্যাসে পরিণত করবো। ছেলেমেয়েদের খারাপ অভ্যাস দেখলে প্রথম থেকেই বারণ করুন। কথায় আছে Don’t leave anyhow for Later. Later you will lose interest, যেমন Later your coffee gets cold. সুতরাং সচেতনতায় প্রতিরোধের একমাত্র পথ। ২। খাদ্যভ্যাস–চর্বি, অধিক কোলেস্টারলযুক্ত খাবার (রেড মিট), অধিক ক্যালারিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, তৈলাক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কোমলপানীয়, মিষ্টিজাতীয় খাবার, আইসক্রিম, পায়েস, সরবত প্রভৃতি অধিকমাত্রায় খাওয়া যাবে না। বিয়েতে কাচ্চি বিরানি, খুব প্রিয়। পরিমাণে খুব কম। ৩। লবণ–অতিরিক্ত লবনে রক্তচাপ বাড়ায়। পাত লবণ খাওয়া যাবে না, সিপসসহ সব প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে অত্যাধিক লবন থাকে। ৪। কায়িক পরিশ্রম– বেশিদিন সুস্থ থাকার একাত্র উপায় দুইবেলা ব্যায়াস বা হাঁটেন আপনার ইনসুলিনের মাত্রা কমে যাবে। কায়িক পরিশ্রম অনেক বড় রোগ থেকে আপনাকে বাঁচাবে। বেশি খাবেন অথচ শরীর নড়াচড়া করবেন না তা হবে না হাটে বাজারে গেলেন অল্প দূরত্বে গাড়িতে চড়বেন না। দোতলা, তিনতলা লিপ্টে না চড়াই ভালো। সাঁতার জগিং ভালো ব্যায়াম। তবে হাঁটা সব চেয়ে ভাল ব্যায়াম। খুব চিন্তা হয় যখন দেখি ১৬–২৫ বছরের ছেলে বা মেয়ের ওজন ৭০–৯০ কেজি। একজন মোটা মহিলা রোগীকে জিজ্ঞাসা করা হলো ‘আপনি এত মোটা কেন, ‘বললেন আমি মোটেই খেতে পারি না। এই স্থুলতা অনেক রোগের কারণ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। পরিমিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান। ৫। অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করুন– টাসফোন, ফেইসবুক, ইউটিউব, কম্পিউটার, টিক্্টক্্, গেম, ইন্টারনেট। এই গুলি বাচ্চা থেকে শুরু করে সবার অলস জীবন যাপন প্রবণ। ৬। যারা অবসরে গেছেন বা বয়স্ক–নিয়মিত হাঁটুন। ছাদে বা বারান্দায়, ব্যায়ামের অভ্যাস করুন। সম্ভব হলে বাগান করুন। ৭। ছোটদেশ ১৮ কোটি মানুষ, হাঁটার জায়গা নেই, ছেলেদের খেলার মাঠ নেই। চারিদিকে বিল্ডিং। ৮ প্রতিনিয়ত বায়ু দূষণে বাড়ছে ফুসফুসের রোগ। ইহা থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। ৯। ধূমপান, মদ্যপান, তামাক পাতা, জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এই গুলি অসংক্রামক রোগের অন্যতম কারণ। ১০। মানসিক ও শারীরিক চাপ, অতিরিক্ত টেনশন থেকে নিজেকে দূরে রাখুন, নতুবা হৃদরোগে ও স্ট্রোকে ভুগবেন ১১। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো, ঘুমানো, রাত্রে শুইতে যাওয়ার সময় হাতে মোবাইল না রাখা। ১২। মনের প্রশান্তির জন্য ধর্মচর্চা অপরিহার্য ১৩ । ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রুটিন রক্ত পরীক্ষা নির্দেশমত করুন। ১৩। কিছু কিছু জন্মগত শারীরিক ব্যাধি থাকে। প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। ১৪। পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পাঠ্য পুস্তকে রোগ প্রতিরোধ সম্বন্ধে প্রবন্ধ সংযোজন সময়ের দাবী ১৫। মনে রাখবেন সব কিছুর মূলে রয়েছে আত্মউপলব্ধি ও সচেতনতা। ঘুরে ফিরে একই কথা ‘Prevention is better than cure’এই বৎসর ২০২৫ সালে ‘নোবেল প্রাইজ’ বিজয়ী তিনজন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয় ছিল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এই যুগান্তকারী গবেষণায় ছিল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কেমন করে নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতি না করে জীবাণু থেকে সুরক্ষা রাখা যায়। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যাতে আমরা সব ধরনের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে পারি। পরিশেষে বলা যায় জনগণ শুনেন, পড়েন, বোধগম্যও হয় তবে মানে না। দেশের আপামর জনসাধারণের প্রতি আহ্বান আপনারা স্বাস্থ্য সচেতন হোন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।











