দেশের গণপরিবহন কোনোভাবেই নারীবান্ধব নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্ক (বিআরএসএন)। সংগঠনটির তথ্যমতে, নগর গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত ‘নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় টেকসই পরিবহন কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবিতে’ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে বিআরএসএন। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনটির সমন্বয়ক পাহাড়ী ভট্টাচার্য। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাসের গেট সরু, সিট অপরিষ্কার ও কাঠামোগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। রোদ–বৃষ্টি কিংবা পিক–আওয়ারে অনেক সময় পরিবহন শ্রমিকরা নারী যাত্রী তুলতে অনিচ্ছুক থাকেন, এমনকি পুরুষ যাত্রীরাও আপত্তি করেন। এতে গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা ও সম্মান মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বিআরএসএন জানায়, বর্তমানে দেশে পাঁচ লাখেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন রয়েছে, যার ৭০ শতাংশ এখনো সড়কে চলাচল করছে। এর মধ্যে ৭৫ হাজার বাস ও ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন, আর ঢাকায় ১০ হাজারের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যান চলছে। সংগঠনটির অভিযোগ, এ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনগুলোই অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ব্যক্তিগত যানবাহন ও রিকশা সড়কের ৭৫ শতাংশ স্থান দখল করে রাখলেও এগুলো মোট যাত্রীর মাত্র ১১ শতাংশ বহন করে। অন্যদিকে গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করলেও সুবিধাবঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মাত্র সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ হাজার নতুন বাস কোম্পানিভিত্তিক পরিচালনা করা গেলে গণপরিবহনে চাঁদাবাজি ও যাত্রী তুলতে প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে এবং নগরবাসী সাশ্রয়ী ও সম্মানজনকভাবে যাতায়াত করতে পারবে।
নারীরা আমাদের দেশে কোথাও নিরাপদ নন। বর্তমানে গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে পাবলিক বাসে যাতায়াত অথচ যৌন হয়রানির শিকার হয়নি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেশের মহাসড়ক, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন জায়গায় দৈনন্দিন প্রয়োজনে চলা ফেরার সময় ঠিক কতজন যৌন হেনস্তার শিকার হন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান জানা যায় না। গণপরিবহন, জনসমাবেশ, রাস্তা–ঘাট, জন সাধারণের সামনে নারী কেবল উত্ত্যক্তের শিকারই হন না, বরং তারা নিগৃহীত, যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এর ভয়াবহতা আমরা দেখতে পাই নানা প্রতিবেদনে।
নারীরা আগে ঘরে নির্যাতিত হতেন। আর এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে ঘরে নির্যাতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাইরেও নির্যাতিত হচ্ছেন! বিশেষজ্ঞদের মতে, যখনই সভ্যতার বিকাশ ও নগরায়ণের কারণে গণপরিবহন ব্যবহারের অপরিহার্যতা তৈরি হলো এবং নারীদের ক্ষমতায়নের কারণে তাঁদের ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ল, তখন গণপরিবহনে যৌন হয়রানির বিষয়টি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হলো। নারীরা বাসে ওঠার সময় বাসচালকের সহকারী ও অন্যান্য পুরুষ যাত্রী দ্বারা অযাচিতভাবে শরীরে বিভিন্নভাবে স্পর্শ, অশ্রাব্য ভাষায় নারীদের লক্ষ্য করে কটূক্তি, ফাঁকা বাসে নারীদের ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। শুধু তা–ই নয়, গাড়িতে ধর্ষণ করে সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ভুক্তভোগী নারীকে হত্যা করে নির্জন স্থানে ফেলে যাওয়ার মতো ঘটনার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।
নারীরা যেখানে ঘর ও কর্মক্ষেত্রের বাইরে গণপরিবহনে নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে দিন দিন ক্রমবর্ধমান হারে গণপরিবহনে নারী হয়রানির ঘটনা বৃদ্ধি রীতিমত উদ্বেগজনক। এভাবে বাড়তে থাকলে একসময় নারী নিরাপত্তা সম্পূর্ণ হুমকির মুখে পড়বে, যা একটা দেশের সুশাসনের মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, রাস্তা–ঘাট, গণপরিবহনসহ সর্বত্র উদ্বেগজনকভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা বেড়েছে। নারীরা স্বাধীন চলাফেরায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। এ অবস্থার উত্তরণের জন্য ‘শূন্য সহনশীলতা’র নীতি গ্রহণ প্রয়োজন।
বিআরএসএন’র সংবাদ সম্মেলনে পাহাড়ি ভট্টাচার্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করলেও সড়ক খাতের নৈরাজ্য প্রতিরোধে কোনো কমিশন গঠন করেনি। তাঁরা নিরাপদ ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে “সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশন’’ গঠনসহ ২০ দফা দাবি জানিয়েছেন।
নারীর জন্য নিরাপদ নগরী গড়তে হলে শুধু আইন নয়, দরকার সামাজিক প্রতিরোধও। প্রতিবাদের ভাষা যত জোরালো হবে, হয়রানির সুযোগ তত কমবে।








