বিপন্নতার মাঝেও ২৬ প্রজাতির সাপের অস্তিত্বের সন্ধান

মাটিরাঙার পিটাছড়া বন

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি | শনিবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় পিটাছড়া বনে ২৬ প্রজাতির সাপের সন্ধান মিলেছে। সুষ্ঠুভাবে প্রাকৃতিকভাবে বন সংরক্ষণ, শিকার বন্ধ ও বনকে উজাড়ের হাত থেকে রক্ষায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা এই বনে সাপের বৈচিত্র্য বেড়েছে। বিপন্নতার মাঝে সাপের বৈচিত্র্যময় উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকৃতির ‘ইকোলজিকাল ইন্ডিকেটর’ সাপের উপস্থিতি বাড়লেও এই এলাকায় সাপের কামড়ে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানান পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ি মাটিরাঙা দুর্গম পিটাছড়ায় একটি পাহাড় কিনে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন তিনি।

মাহফুজ রাসেল বলেন, এখন পিটাছড়ায় বনের আয়তন বেড়েছে। আট বছর আগে বনের পরিমাণ ছিল পৌনে ৫ একর। এখন রয়েছে প্রায় ৫০ একর। এর মধ্যে ছড়ার পাশাপাশি অসংখ্য ছোট ঝিরিও আছে। ৫০০ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম এবং ১৭ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে বনে। প্রায় ৩৬ একর জুড়ে সবুজ পাহাড় ও বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ আবৃত এই বনে শঙ্খিনী, সবুজ ফনিমনসা, লাউডগা, কিং কোরবা, দুধরাজ, পদ্ম গোখরা, কৃষ্ণ কালাচসহ ২৬ প্রজাতির সাপের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। সুষ্ঠুভাবে বন সংরক্ষণ, ঝিরিতে সারা বছর পানি প্রবাহ থাকায় ও শিকার না হওয়ার কারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ সাপের আবাস গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ থাকলেও সাপের দ্বারা কেউ আক্রান্ত হয়নি। এটি মানুষ ও সাপের সহবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি আরো বলেন, এখানে বন দেখার বন গবেষক, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী, নির্সগ্রপ্রেমীরা প্রায় প্রতি সপ্তাহে বেড়াতে আসেন। বনে ঘুরে বেড়ান। রাত যাপনও করেন। কেউ কেউ করেন জঙ্গল ট্র্যাকিং। কিন্তু গত আট বছরের মধ্যে কেউ সাপ দ্বারা আক্রান্ত হননি। অনেকবার এমন হয়েছিল আমরা বসে গল্প করছি, আড্ডা দিচ্ছি, সাপ আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কাউকে আক্রমণ করছে না। বলা যায়, মানুষ ও সাপের স্বাভাবিক সহবস্থান রয়েছে। বনের ইকোসিস্টেম ভালো থাকার কারণে এত প্রজাতির সাপ দেখা গেছে। সাপ থাকায় তা সুষ্ঠু খাদ্যশৃঙ্খল বা বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়েছে। সাপ যেমন বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রাণী খাচ্ছে তেমনি সাপ খেয়ে বেজি, শকুন, গুইসাপসহ অন্যান্য প্রাণী বেঁচে আছে।

পিটাছড়ার বনে দীর্ঘদিন সাপ নিয়ে কাজ করছেন স্নেক রেসকিউ টিমের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুর রহমান রাব্বি। তিনি বলেন, প্রকৃতির ইকোলজিকাল ইন্ডিকেটর সাপের উপস্থিতি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের সহায়ক। কোন বনে সাপের বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থিতি থাকলে সে বনের প্রাণীদের সুষ্ঠু বাস্তুসংস্থান টিকে থাকে। শিকার বা হত্যা, বন উজাড়ের কারণে সাপ বিপন্নতার মাঝে পিটাছড়ায় ২৬ প্রজাতির সাপের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া সত্যিই ইতিবাচক একটি ঘটনা। এটা প্রমাণ করে সঠিকভাবে বন ব্যবস্থাপনা করলে প্রকৃতিতে জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমরা এখন পর্যন্ত পিটাছড়ায় দুধরাজ, বেতআছড়া, ঘরগিন্নি, ঝাউ এর ঘরগিন্নি, হলুদ ছোপ ঘর গিন্নি, গ্রীন পিট ভাইপার, মক ভাইপার, ইন্দোচীনা দাঁড়াশ, পদ্ম গোখরাকৃষ্ণ কালাচ, শঙ্খনী, গ্রীন ক্যাট স্নেক বা সবুজ ফনিমনসা, টাউনি ক্যাট স্নেক বা খয়েরী ফনিমনসা, লাল গলা ঢ়োড়া, জল ঢ়োড়া, ব্যান্ডেড কুকরী, লাউডগা, হেলে, চেরাপুঞ্জি কিলব্যাক, পাকড়া উদয় কাল সাপ বা হোয়াট ব্রাডেট কুকরী, রাসেলস কুকরী, ব্রাহ্মণী দুমুখো সাপ, ডায়ার্স এর দুমুখো সাপ, অজগর, কিং কোবরা ও দাঁড়াশের সন্ধান পেয়েছি। ভবিষ্যতে সাপের আরো নতুন প্রজাতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, ইঁদুর, ছুঁচো ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী খেয়ে ফসল রক্ষা করার পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সাপ। সাপ দেখলেই মেরে ফেলতে হবে এরকম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পিটাছড়ায় এত প্রজাতির সাপ থাকলেও কাউকে দংশন করেনি। তাদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে দিতে হবে। এরা প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার পিটাছড়া বনে গিয়ে সেখানকার প্রাণ প্রাচুর্যতা দেখেছি।

সাপ শিকার ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে প্রায় সব সাপের প্রজাতি সংরক্ষিত। সংরক্ষিত সাপের প্রজাতি হত্যা বা পাচার করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাটওয়ারীর পদত্যাগের খবর, এনসিপির অস্বীকার
পরবর্তী নিবন্ধউন্মুক্ত হলো রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু, পর্যটকের ভিড়