রাউজান উপজেলার নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের হালদা পাড়ের উন্নয়ন বঞ্চিত একটি গ্রাম ফতেহ নগর। বিশাল গ্রামটির সংযোগ রাউজান–হাটহাজারী–ফটিকছড়ির ত্রিসীমানায়। হালদা নদীর পশ্চিম পাড়ে হাটহাজারী উপজেলার ইউনিয়ন লাঙ্গলমোড়া। পূর্বপার্শ্বে থাকা রাউজানের ফতেহনগর ও পাশে রয়েছে ফটিকছড়ির শাহানপুর ইউনিয়ন। আদিকাল থেকে তিন উপজেলার মানুষের নিত্যদিনের যোগাযোগ, আত্মীয়তার সেতু বন্ধনের মাধ্যম হয়ে আছে ফতেনগর গ্রামের সাথে থাকা হালদা নদীর নৌঘাটের একটি দঁড়ি টানা নৌকা। এটিই এই অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা। এই ঘাটের সাথে তিন উপজেলার মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবন ধারণের নিবিড় সম্পর্ক।
ওই এলাকার পরিদর্শনে গিয়ে কথা হয় তিন উপজেলার কয়েকজন মানুষের সঙ্গে। তারা বলেন, রাউজান ও ফটিকছড়ির আলোচিত দুটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষের বিভিন্নমুখী যাতায়াতের সহজ পথ হাটহাজারীর নাঙ্গলমোড়া হয়ে। ইউনিয়ন দুটির মূল সড়কের সাথে গ্রামগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যুগে যুগে গ্রামীণ রাস্তাগুলো উন্নয়ন বঞ্চিত। গ্রামের মানুষ বিধ্বস্ত রাস্তায় ইউনিয়নের মূল সড়কে যাওয়া আসা অনেকটা যেতে কষ্টসাধ্য। এ কারণে বাপ–দাদার আমল থেকে তাদের যোগাযোগ নদীর ওপারে থাকা লাঙ্গলমোড়া হয়ে। তাদের জীবন জীবিকা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আত্মীয়তা নদীর এপার–ওপারের মানুষের সাথে।
এলাকার লোকজনের কাছে জানা যায়, হালদার নদীর ফতেনগর ঘাটের বার্ষিক ইজারা হয়। ইজারা দেয় রাউজানের নোয়াজিশপুর ইউনিয়ন পরিষদ। ইজারাদার শুষ্ক মৌসুমে এখানে নদীর উপর গাছ, বাঁশের উপকরণে তৈরী করে দেন সাঁকো। এই সাঁকোতে পারাপারে দিতে হয় মাথাপিছু ১০ টাকা করে। গরু–ছাগল পারাপারেও দিতে হয় টাকা। সাঁকোর উপর দিয়ে চলাচল করে অটোরিকশা, মোটরসাইকেলও। এসব গাড়ি থেকে টোল নেন ২০ টাকা হারে।
জানা যায়, হালদা নদীর উৎপত্তিস্থল পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদী হয়ে নেমে আসা পানির স্রোতের তীব্রতায় ইজারাদারের সাঁকোটি ধসে যায়। এসময় ইজারাদার পারাপারে জন্য দঁড়ি টানা বড় নৌকা রাখেন। বর্ষা চলে গেলে নতুন করে নির্মাণ করে দেন বাঁশ–কাঠের সেতু। পরিদর্শনকালে দেখা যায়, এই ঘাটে নদীর এপার–ওপারে টাঙানো আছে লম্বা দঁড়ি। এই দঁড়ি টেনে একটি বড় নৌকায় মানুষ পারাপার করছে।
নদীর পাড়ে দেখা গেছে নতুন সাঁকো তৈরিতে গ্রামবাসীকে নিয়ে ইজারাদারের বাঁশ–গাছ নিয়ে ব্যস্ততা। এখানে বাঁশের পাটাতন তৈরীর কাজে ব্যস্ত ষাটোর্ধ্ব বয়সী ফটিকছড়ির বাসিন্দার আবদুস শুক্কুর বলেন, নদীর পশ্চিম পাড় হাটহাজারীর দিকে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেও রাউজান ও ফটিকছড়ির (হালদা পাড়ের) দুটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই করুণ। রাউজান ফটিকছড়ির কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা উন্নত রাস্তাঘাটের অভাবে মূল রাস্তাঘাটের সাথে অনেকটা যোগাযোগ বিছিন্ন। আদিকাল থেকে গ্রামগুলোর মানুষের জীবন জীবিকাসহ নানামুখি যাতায়াত এই ঘাট পারাপারের মাধ্যমে। গ্রামগুলোর অধিকাংশ ছেলেমেয়ের এই পথে হাটহাজারী গিয়ে স্কুল মাদরাসায় লেখাপাড়া করে। হাটবাজার সব হয় ওপার থেকে।
সাঁকোর কাজে ব্যস্ত থাকা ফতেহনগরের অপর একজন মোহাম্মদ মুছা বলেছেন, প্রতিবছরের মত বর্ষায় পানি স্রোতে ভেসে গেছে আগের সাঁকোটি। বিকল্প হিসাবে আগের নিয়মে পারাপার হচ্ছে দঁড়ি টানা নৌকায়। এখন বর্ষা প্রায় শেষ হতে চলায় নতুন সাঁকো নির্মাণ কাজ চলছে।
জানা যায়, বহু বছর ধরে এই ঘাটের ইজারাদার রুহুল আমিন মাঝি। ঘাটের কাজের তদারকিতে থাকা মাঝির ছেলে নুরুল আজম বলেছেন, এবার এই ঘাটের ইজারা মূল্য (বার্ষিক) ৪০ হাজার টাকা। তিনি জানান, সাঁকো নির্মাণে প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হবে। নির্মাণ কাজে নিজেদের বিনিয়োগের পাশাপাশি তিন উপজেলার কয়েকজন দানশীল ব্যক্তি সাঁকো নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। ঘাটের দঁড়ি টানা নৌকার মাঝি মোহাম্মদ লিটনের কাছে জানা যায়, এই পথে দৈনিক হাজার খানেক মানুষ যাওয়া আসা করে।
ফতেহনগরের আলোচিত এই নৌঘাটে মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে কথা বললে নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপি নেতা নুরুল হুদা বলেন, বিগত ১৭ বছর যারা উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে তারা চাইলে বিছিন্ন গ্রামগুলোর সাথে মূল সড়কগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারতো। কিন্তু তারা সেটি করেনি। তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে উন্নয়ন বঞ্চিত গ্রাম সমূহের রাস্তাঘাটের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। ফতেহনগরসহ ওই এলাকার মানুষের দুর্ভোগের অবসান হবে।
রাউজান উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একদল প্রকৌশলী ওই পথে ব্রিজ নির্মাণ সম্ভাবনা দেখে গিয়েছিলেন। পরে এই নিয়ে কি হয়েছে তা তিনি জানেন না।












