সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কার

দেলোয়ার মজুমদার | শুক্রবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশাল ত্যাগ স্বীকার করে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করেছি। স্বপ্ন ছিল দেশে গণতন্ত্র থাকবে, মানুষ শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবে, সুশাসন দৃশ্যমান থাকবে। বাস্তবে কখনো কখনো গণতন্ত্রের ঝিলিক দেখলেও গণতন্ত্র আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে উন্নয়নের ধারায় অবকাঠামোগত ও প্রবৃদ্ধি দৃশ্যমান হলেও সীমাহীন লুটপাটের ধারায় এর সুফল বন্টনে ন্যায্যতা ছিল না। এই লুটপাটের ধারা অব্যাহত রাখতে গণতন্ত্রের সকল ভিত্তি ধ্বংস করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে করে ফেলা হয়েছে অকার্যকর। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে। উন্নয়নের ধারায় প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত সাফল্য দৃশ্যমান হলেও রাজনীতির উপর মানুষের আস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই আসন্ন নির্বাচনের উপর জনগণের প্রত্যাশা পর্বত, সাথে আছে আশানিরাশার দোলাচল। কাজেই আগামী নির্বাচন কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়এটি হতে হবে গণতন্ত্র, ন্যায় ও জবাবদিহিতা পুনর্গঠনের এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের এক ঐতিহাসিক সুযোগ। এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে সততা, যোগ্যতা ও জনগণের আস্থার ভিত্তিতে অর্থ, পেশীশক্তি কিংবা উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নয়। গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে স্বাধীন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা। এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরী করে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে ধরে আমরা যে নির্বাচন কমিশন দেখছি তা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কমিশন নিয়োগে সরকার দলীয় পছন্দের প্রভাবের কারণে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী কাউকেও এই কমিশনে দেখা যায় না।

এ অবস্থা পরিবর্তনে প্রথম প্রয়োজন কমিশনের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা। বাজেট অনুমোদন সংসদের বিশেষ কমিটি দ্বারা হতে হবে, কোনো নির্বাহী মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নয়।

কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, নারী প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের নিয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে।

মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও তদারকি কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে উক্ত কাজে সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত বদলি বা কোন শাস্তির সিদ্ধান্ত নির্বাচন পরবর্তী সরকার এক বছরের মধ্যে রদ করতে না পারার বিধান করতে হবে। এছাড়া ভোটগ্রহণ ও ফলাফল ব্যবস্থায় ডিজিটাল অডিট সিস্টেম চালু করা গেলে কারচুপি বা ফলাফল বিকৃতির ঝুঁকি কমবে।

অর্থ ও পেশীশক্তিমুক্ত নির্বাচন: যোগ্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত

বর্তমান নির্বাচনী সংস্কৃতি ক্রমেই অর্থ ও প্রভাবনির্ভর হয়ে উঠেছে। ফলে অনেক সৎ, যোগ্য ও জনগণমুখী নাগরিক নির্বাচনে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত হন। গণতন্ত্রের মূলধারা ফিরিয়ে আনতে হলে অর্থনির্ভর রাজনীতি থেকে সরে এসে নীতি ও সক্ষমতাভিত্তিক প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে হবে।

প্রয়োজনীয় সংস্কারসমূহ:

রাষ্ট্রীয় অনুদানভিত্তিক তহবিল: কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মোট প্রদত্ত ভোটের নির্দিষ্ট শতাংশ ভোট পেলে এবং নির্ধারিত সাংগঠনিক মানদণ্ড পূরণ করলে সরকারি অনুদান পাবে। এতে আর্থিক বৈষম্য কমবে এবং অবৈধ অর্থ সংগ্রহ বন্ধে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।

তহবিল সংগ্রহের উৎস প্রকাশ বাধ্যতামূলক: দল ও প্রার্থীর তহবিল সংগ্রহের সকল উৎস প্রকাশ করতে হবে এবং বিদেশি অনুদান বা অস্বচ্ছ অর্থ লেনদেন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

ব্যয় নিরীক্ষা ইউনিট গঠন: কমিশনের অধীনে একটি স্বাধীন Election Expenditure Audit Unit গঠন করে প্রার্থীর ও দলের ব্যয় নিরীক্ষা করা উচিত।

পেশীশক্তি নিয়ন্ত্রণ:হোন্ডা আর গুন্ডা’ আমাদের দেশে একটি প্রচলিত কথা, এটি দ্বারা পেশীশক্তি বুঝায়। এটি নিয়ন্ত্রণে নির্বাচনের সময় কার্যকর ভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে;

কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব থাকবে না। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে: নির্বাচনকালীন প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ব্যাক্তিগত সুযোগসুবিধার প্রত্যাশায়। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের সময় প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে, যা পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।

এ থেকে উত্তরণের পথ হলো নির্বাচনকালীন প্রশাসনকে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা। নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বদলি কমিশনের অনুমতি ছাড়া করা যাবে না। সরকারি সম্পদ বা গাড়ি নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহারে শূন্য সহনশীলতা নীতি প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে একটি ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো’ গঠন করা যেতে পারে, যা কমিশনের অধীনে পরিচালিত হবে এবং মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে এবং কারও বিরুদ্ধে কমিশনের নেয়া কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সহজে পরিবর্তন করতে না পারার বিধান থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র: গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এবং গণতন্ত্রকে স্থায়ী চর্চার বিষয় করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জরুরি।

দেশের দুয়েকটা দল ছাড়া সিংহভাগ দলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কেন্দ্রীয় প্রভাব ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাপে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতার ইচ্ছায়। দলগুলোর নিয়মিত কাউন্সিল ও ভোটাভুটি প্রায় অনুপস্থিত, কাউন্সিল হলেও কমিটি নাজিল হয় শীর্ষ নেতা বা কেন্দ্রীয় কোন প্রভাবশালী নেতার পকেট থেকে। এর ফলেই জন্ম নেয় মনোনয়ন বাণিজ্য, দলীয় বিভাজন ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা। কাজেই দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চাকে দলীয় নিবন্ধন টিকিয়ে রাখার কার্যকর অপরিহার্য পূর্বশর্তে পরিনত করতে হবে। এছাড়া দলের সদস্য নিবন্ধন তালিকা সংরক্ষণ ও তা প্রতিবছর হালনাগাদকরণের পর নির্বাচন কমিশনে অবহিতকরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। আরও নিশ্চিত করতে হবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দলের সদস্য না থেকে কেউ দলীয় মনোনয়ন পাবার যোগ্য হবেন না।

দলগুলোর গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ধারা সংযোজন: দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট মেয়াদে নিয়মিত কাউন্সিল আয়োজন বাধ্যতামূলক করতে হবে। ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব কমিটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠন করতে হবে।

মনোনয়ন বাণিজ্য রোধে ‘পার্টি ইথিকস কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে, যারা অভিযোগ পেলে তদন্ত করে শাস্তির সুপারিশ করবে। প্রার্থী মনোনয়নে নির্বাচনী এলাকার ভোটার বা প্রতিনিধিদের মতামতকে প্রাধান্য দিলে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হবে। অর্থ, প্রভাব বা গডফাদার নয়, জনগণের আস্থাই হবে মনোনয়নের মাপকাঠি।

প্রার্থীর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা: বর্তমানে প্রার্থীর বিশাল নির্বাচনী ব্যয় দৃশ্যমান হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। প্রার্থীর বর্তমান ব্যয়ের সীমা আরও কমিয়ে সকল প্রার্থীদের জন্য বহনযোগ্য মাত্রায় আনতে হবে। এবং আইনের মাধ্যমে তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। কমিশনকে আইনগতভাবে ব্যয় নিরীক্ষা, তদন্ত ও শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দিতে হবে। প্রত্যেক প্রার্থীকে নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে নিরীক্ষিত ব্যয় বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। তথ্য গোপন বা জাল বিবরণী দিলে প্রার্থিতা বাতিল এবং পরবর্তী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। ব্যয়ের সব লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে; নগদ অর্থ ব্যবহারে নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করতে হবে।

নির্বাচনোত্তর কেমন শাসন চাই: সরকার এবং দল একিভুত হয়ে যাক এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়, দলের নীতি সরকারে প্রতিফলিত হতেই পারে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতেই হবে।

একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সুশাসনের প্রথম ধাপ মাত্র। নির্বাচনের পর প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে নীতি, তথ্য ও নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত করতে হবে। সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সভাপতির পদ বিরোধীদলের হাতে থাকা উচিত।

নীতিনির্ধারণে নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া স্থানীয় সরকারকে আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে, বড় সিটি কর্পোরেশনগুলোকে এখনই কার্যকর সিট গার্মেন্টসে রূপান্তর করতে হবে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করলে তৃণমূল গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে এবং কেন্দ্রীয়করণ হ্রাস পাবে এবং সেবার মান উন্নত হবে।

বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ: সুশাসনের লক্ষ্য

সুশাসনের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে সুযোগ নির্ধারিত হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, সম্পদ কিংবা প্রভাবের ভিত্তিতে নয়।

শহর ও গ্রামের মধ্যে উন্নয়নের ফারাক কমানো, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে স্বচ্ছ ও আরও বিস্তৃত করা ন্যায়ভিত্তিক সমাজের অপরিহার্য উপাদান।

একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি ভিত্তি

) স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন।

) অর্থ, প্রভাবমুক্ত ও তৃণমূল নির্ভর রাজনীতি।

) দলীয় গণতন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

উপসংহার

গণতন্ত্র সকল নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই কেবল নিশ্চিত হয়। শুধুমাত্র ভোট নয়, এটি একটি সংস্কৃতি যেখানে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে নৈতিকতা ও জনগণের আস্থার ওপর।

অর্থ, পেশীশক্তি ও প্রশাসনিক প্রভাবের রাজনীতি পরিত্যাগ করে এখন সময় সততা, যোগ্যতা ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার। ফেয়ার নির্বাচন, স্বচ্ছ দলীয় কাঠামো ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলে বাংলাদেশ হবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও টেকসই গণতন্ত্রের দেশ, যেখানে জনগণের ভোটই হবে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস।

লেখক : প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, চিন্তক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা বিস্তারে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা