কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। প্রায় সময় যেতে হয়– ডাক্তারের কথামত কখনো ৬ মাস পর, কখনো এক বছর পর। এবার সঙ্গে ছেলের এক বন্ধুও ছিল। নাম শোভন। সেখানে পৌঁছার পর শোভন জানাল, সে একজোড়া জুতা কিনবে। বললাম, খুব ভাল কথা। এখানে খুব ভালো ব্র্যান্ডের কেডস পাওয়া যায়। কাল মলে গিয়ে কিনব। সে রাজি হয়ে গেল।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একা একা বের হলাম। হোটেল থেকে কিছুটা দূরে একটা বড় শপিং মল। সেখানে কেডসের দোকানও আছে বেশ কিছু। কেডস পরে হাঁটতে সুবিধা। এ জন্য চামড়ার শক্ত জুতা পরা এখন অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে। কেডস বা স্নিকারের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ এগুলো হাত লাগিয়ে পরতে হয় না। জাস্ট স্লিপ ইন বা পুশ ইন করলেই চলে।
কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখার পর চোখে পড়ল বিখ্যাত ব্র্যান্ড পুমা (PUMA)- এর দোকান। একজোড়া কেডস পছন্দ হলো। জুতার ওপর লাগানো আছে সেই পরিচিত লোগো (লাফানো বিড়াল)। সেই দোকানে তখন সেইল চলছিল। দোকানের বাইরে বড় বড় হরফে লেখা -‘বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি’। পরদিন দুপুরে তাকে নিয়ে সেই দোকানে গেলাম। সবিস্তারে শোনালাম পুমার জুতার সাতকাহন। বললাম, বর্তমানে বাজারে কেডস এর সেরা ব্র্যান্ড হলো পুমা। আগের দিন ঠিক করে রাখা জুতা জোড়া তার জন্য পছন্দ করলাম। আর তাকে বুঝালাম– আমি এক জোড়া ফ্রি নিচ্ছি বলেই তাকে এক জোড়া কিনতে দিচ্ছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। অর্থাৎ আমাকে বুঝিয়ে দিল যে, যা বোঝার সে বুঝে গেছে। সে একজোড়া নতুন কেডস কিনল, আর আমিও একজোড়া পায়ে গলিয়ে পুরনোটা বাক্সবন্দী করে হোটেলে ফিরে এলাম।
‘ফ্রি’ শব্দটি শুনলেই ক্রেতা হিসাবে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা আলোড়িত হই। আমরা যা–ই মিস করি না কেন, ফ্রি কিছু মিস করতে চাই না। বাস্তবতা হচ্ছে আজকের দুনিয়ায় কেউ কাউকে কিছু ফ্রি দেয় না। এটা একটা ব্যবসায়িক কৌশল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে – Free means a fresh trap. ফ্রি মানে নতুন ফাঁদ। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি। পুমা নিয়ে আরেকটু আলোচনা করতে চাই।
পুমা একটি জার্মান বহুজাতিক কোম্পানি। এর মূল অফিস জার্মানির হার্জোগেনাউরাচ শহরে। রুডলফ ডাসলার এবং অ্যাডলফ ডাসলার নামে দুই ভাই মিলে প্রায় একশ বছর আগে ‘ডাসলার ব্রাদার্স সু ফ্যাক্টরি’ নামে একটি কোম্পানি শুরু করেছিলেন। বেশ ভালই চলছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ১৯৪৮ সালে তারা আলাদা হয়ে যান। এরপর অ্যাডলফ প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাডিডাস। আর রুডলফ প্রতিষ্ঠা করেন পুমা। বর্তমানে এই দুটিই জগদ্বিখ্যাত স্পোর্টস ব্র্যান্ড। পুমা হলো এক ধরনের বড় বুনো বিড়াল– যা ক্ষিপ্রতা, শক্তি ও সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। অ্যাডিডাস নামটি এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডলফ ডাসলারের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। তার ডাক নাম ছিল অ্যাডি, আর এর সাথে তার পদবি ডাসলারের প্রথম তিন অক্ষর মিলিয়ে অ্যাডিডাস শব্দটির সৃষ্টি। তবে কেউ কেউ অন্য ব্যাখ্যাও দেন। তাদের মতে, ADIDAS মানে All Day ও Dream About Sports.
এই দুই ভাই এতই বিখ্যাত ছিলেন যে– তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তাদের জন্মস্থান হার্জোগেনাউরাচ শহরটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, শহরের বাসিন্দারা অ্যাডিডাস বা পুমার যেকোনো একটিকে সমর্থন করতেন, এবং এই বিভাজন এতটাই তীব্র ছিল যে অনেকে দুই পক্ষের মধ্যে বিয়ে পর্যন্ত করতেন না। তারা আলাদা আলাদা বার, বেকারি ও সেলুনে যেতেন। বাসিন্দারা এক অন্যের সাথে দেখা হলে প্রথমে ঘাড় নিচু করে তাকাতেন একে অন্যের পায়ের দিকে। লক্ষ্য করতেন কে কোন কোম্পানির জুতা পরেছে। জুতা দেখেই সিদ্ধান্ত নিতেন কে কোন কোম্পানির সমর্থক। এই অদ্ভুত অভ্যাসের কারণেই শহরটির নাম হয়ে যায় ‘টাউন অফ বেন্ট নেকস’। বা ‘বাঁকানো ঘাড়ের মানুষের শহর’।
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে অ্যাডিডাস ও পুমা, দুই কোম্পানিই পেলেকে চুক্তিবদ্ধ না করার জন্য একটি অলিখিত চুক্তি করে, যাতে কোনো বিডিং–যুদ্ধ না হয়। কিন্তু পুমা গোপনে পেলেকে চুক্তিবদ্ধ করে ফেলে। খেলা শুরুর ঠিক আগে, পেলে–কে লাইভ টেলিভিশনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তাঁর জুতার ফিতা ঠিক করতে দেখা যায়। এতে কোটি কোটি দর্শক দেখেন যে তিনি পুমার জুতো পরে আছেন। এরপর তাদের বিরোধ আরও চরমে ওঠে। প্রসঙ্গত, পেলের মত ম্যারাডোনারও স্পন্সর ছিল পুমা। বিশ্বের দ্রুততম মানব হিসাবে পরিচিত উসাইন বোল্টেরও স্পন্সর পুমা। এটি এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্পোর্টসওয়্যার কোম্পানি। দ্বিতীয় স্থানে আছে অ্যাডিডাস ও প্রথম স্থানে আমেরিকান ব্র্যান্ড নাইকি (NIKE).
এই দুই ভাই সেই ৭০–এর দশকেই মারা যান। তবে তাদের দীর্ঘদিনের বিবাদের রেশ মৃত্যুর পরেও রয়ে যায়। তাদের দুজনকে একই কবরস্থানে সমাধি দেয়া হলেও, দুই ভাইয়ের সমাধি রাখা হয় একে অপরের থেকে অনেক দূরে। ২০০৯ সালে, তাদের মৃত্যুর বহু বছর পর, দুই কোম্পানির কর্মীরা একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচে অংশ নেয়, যা দুই পক্ষের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের শত্রুতার অবসান ঘটায়। তবে ভাইদের জীবদ্দশায় এই পুনর্মিলন সম্ভব হয়নি।
আবার ফ্রির কথায় আসি। একটা কিনলে একটা ফ্রি– এই কনসেপ্ট নতুন নয়। প্রায় দেড়শ দুইশ বছর আগে ইউরোপের বণিকরা প্রথম বিনামূল্যে পণ্য দিয়ে গ্রাহক ধরার কৌশল চালু করেন। এরপর এ ধারণা বিকশিত হয় আমেরিকায়। সেদেশে একজন কেমিস্ট ছিলেন Asa Candler. তিনি কোকাকোলার প্রাথমিক মালিক। ১৮৮৭ সালে তিনি ৮৫ লাখের মত কুপন ছাপান, যেখানে লেখা ছিল– This coupon entitles you to one free glass of coca-cola. মানুষ তো অবাক– ফ্রি পানীয়! ফল হয় আশ্চর্যজনক। কয়েক বছরের মধ্যেই কোকাকোলা হয়ে ওঠে আমেরিকার প্রিয় পানীয়। এটাকে বলা হয়– The first great Free Revolution in marketing. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল সুপার চেইন শপ। এই সময়েই বিজ্ঞাপনে দেখা যায় নতুন এক বাক্য– Buy One, Get One Free. এই অফার এত জনপ্রিয় হয় যে, এই কনসেপ্ট সংক্ষেপে BOGO নামে পরিচিতি পায়।
বলা হয়, ফ্রি শব্দটা এমন এক জাদুমন্ত্র যা বুদ্ধিমানকেও বোকার মত উল্লসিত করে তোলে। আর কৃপণকেও হাত খুলে খরচ করতে শেখায়। মার্কিন ব্যবসায়ীরা বহু হিসাব নিকাশ করে দেখেছেন যে, ফ্রি শব্দটি যুক্তির চেয়েও বেশি শক্তিশালী। কোনো পণ্যে ৫০ শতাংশ ছাড় দিলে যে সাড়া পাওয়া যায়, ‘একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি’ দিলে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সাড়া মেলে। অথচ হিসাব করলে দুইটাই একই কথা। বিজ্ঞাপনের ফ্রি শব্দটা মানুষকে বিমোহিত করে। সে ভাবে এখনই না কিনলে বুঝি সব শেষ! এখন ইন্টারনেটের যুগ। ফ্রি শব্দটিও নিয়েছে নতুন চেহারা। ফ্রি সার্ভিস, ফ্রি ট্রায়াল, ওয়ান মান্থ ফ্রি, আরো কত রকম শব্দ। এগুলো শুনতে যত সহজ, বুঝা তত কঠিন। কারণ আগে পণ্য বিনিময় হত টাকায়। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে আপনার মনোযোগ ধরে রাখা, আপনাকে আকৃষ্ট করে রাখা ডিজিটাল স্ক্রিনে।
BOGO শব্দটির আরো একটি মানে আছে। Buy One, এরাব One. এর সাথে জড়িয়ে আছে ব্লেক মাইকোস্কির নাম। তিনি একজন আমেরিকান উদ্যোক্তা ও লেখক। TOMS নামের একটি জুতো কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০০৬ সালে মাইকোস্কি আর্জেন্টিনা ভ্রমণে যান। সেখানে অনেক শিশুকে দেখেন যাদের পায়ে কোনো জুতো ছিল না। তাদের কষ্ট দেখে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং নতুন এক মডেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। এই মডেলে, একজন গ্রাহক যখন এক জোড়া জুতো কেনেন, তখন কোম্পানিটি একজন অভাবী শিশুকে এক জোড়া জুতো দান করে। এটি কেবল একটি বিপণন কৌশল ছিল না, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন ছিল যা গ্রাহকদের মধ্যে একটি ভালো কাজে অংশগ্রহণের অনুভূতি তৈরি করেছিল। এটি প্রমাণ করে যে BOGO কেবল বাণিজ্যিক লাভের জন্যই নয়, বরং সামাজিক কল্যাণের জন্যও ব্যবহার করা যায়।
আগেই বলেছি, ব্লেক মাইকোস্কি একজন লেখকও। তার বই– Start Something That Matters নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পেয়েছিল। সেই বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েই লেখাটি শেষ করছি। তিনি লিখেছেন– You don’t have to be perfect to start, but you have to start to be perfect… When you start with a genuine desire to help, your business will be stronger. সাদামাটা বাংলায় আমরা বলতে পারি, শুরু করতে হলে আপনাকে একবারে পারফেক্ট হতে হবে এমন নয়, কিন্তু পারফেক্ট হওয়ার জন্য আপনাকে শুরু করতেই হবে।… আর যখন আপনি সত্যিকার সাহায্যের ইচ্ছা নিয়ে শুরু করেন, তখন আপনার ব্যবসা আরো শক্তিশালী হয়।