স্বাধীনতার পর থেকে যে সকল সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় সব সরকারই আমাদের ছোট আয়তনের এই বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত তৎপর ও সক্রিয় ছিল। ১৯৭২ থেকে প্রায় ২০০৫ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারগুলোর গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগে আশাতিরিক্ত সুফল পাওয়া গিয়েছিল। এই সময়কালে আমরা দেখেছি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর থেকে সংবাদপত্র, রেডিও–টিভি সহ বিভিন্ন মাধ্যমে অবিরাম প্রচারণা চালাতে। জন্মনিয়ন্ত্রণ করার ফলে প্রাপ্ত সুফল, না করার কুফল, সহজ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, বিনামূল্যে এবং নামমাত্র মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজ লভ্যতা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত, সচেতন, সক্রিয় এবং উৎসাহিত করা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করাই ছিল এ প্রচারণার মূল লক্ষ্য।
এছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মাঠ পর্যায়ের মহিলা কর্মীরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে গিয়ে সন্তান জন্মদানে সক্ষম মহিলাদের সহজ সরল ভাবে বুঝাতেন এবং বিনামূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণ করতেন। তখনকার অত্যন্ত জনসমাদৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ‘রাজা’ ও ‘মায়া’র কথা নিশ্চয় অনেকের স্মরণে আছে। এছাড়া তখন পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর কর্তৃক বহুল প্রচারিত বিভিন্ন স্লোগান মানুষের মনোযোগ আকর্ষণে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের প্রতি তাদের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। ছোট পরিবার সুখী পরিবার, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক একটি সন্তানই যথেষ্ট, বুদ্ধিমান হোন ঠিক কাজটি করুন – এ সকল স্লোগানের মূল বার্তা তখন মানুষ খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রকৃত অর্থে তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের বর্তমানের স্তিমিত কার্যক্রমের ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টির প্রতি মানুষের উদাসীনতার সাথে যোগ হয়েছে আর এক নতুন উপসর্গ। এই নতুন উপসর্গের নাম রোহিঙ্গা। প্রাকৃতিক কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। এছাড়া শিক্ষার আলো বঞ্চিত, দারিদ্র পীড়িত এবং ধর্মীয় গোড়ামিতে আচ্ছন্ন এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কর্তৃক জন্মশাসন না মানার পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞতা তাদের সন্তান জন্মদানের হারকে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ করার সুফল এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ না করার কুফল সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা এবং উদাসীনতার প্রধান কারণ শিক্ষার অভাব এবং তাদের ধর্মীয় নেতাদের বিরোধিতা। আমাদের দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী এই রোহিঙ্গারা বিগত সাত বছরে অব্যাহত গতিতে আতঙ্কজনকভাবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে। জনস্ফীতিতে ভারাক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সরকার এবং জনগণ যথেষ্ট উদারতা ও মানবতা দেখিয়ে তাদের অন্ন–বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ তাদের জন্য ভিন্্ দেশ। কিন্তু ভিন্্ দেশের ভিন্ন পরিবেশের আশ্রয় শিবিরে বসবাস করার সময় কালে সন্তান জন্মদানে সংযমী হওয়ার মত জ্ঞান বা চেতনাবোধ তাদের নেই। টেকনাফ–উখিয়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী রোঙ্গিাদের সংখ্যা এই দুই এলাকার প্রকৃত বাসিন্দাদের সংখ্যাকে অনেক আগেই অতিক্রম করে গেছে এবং প্রতিদিন এই ব্যবধান বাড়ছে। তারা আমাদের টেকনাফ–উখিয়া–নাইক্ষ্যংছড়ির বনভূমি উজাড় করে দিয়ে এই এলাকাকে অক্সিজেন শূন্য করে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের একটি অংশ ইতিমধ্যে মাদক, মালয়েশিয়ায় মানব পাচার, বেআইনীভাবে বাংলাদেশের নাগরিক সনদ ও পাসপোর্ট সংগ্রহের মত মারাত্মক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে। আশ্রয় শিবির থেকে পালিয়ে গিয়ে তাদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে নানা বিষয়ে তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে এবং আমাদের কক্সবাজার ও বান্দরবানের শান্ত সামাজিক পরিবেশ অশান্ত করে তুলেছে। টেকনাফ–উখিয়ায় তারা এখন সংখ্যাগুরু আর আমাদের এখানকার প্রকৃত নাগরিকরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।
আলোচ্য বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মারাত্মক সমস্যা। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে কোনোক্রমেই আর কালক্ষেপণ করা যাবে না। এ সমস্যা মোকাবেলা এবং এর সমাধানের জন্য আমি মনে করি : (১) সরকার দেশের অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ, অর্থনীতিবিদ, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার স্থানীয় নেতৃবর্গের পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে উপায় উদ্ভাবন করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। (২) আমাদের পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরকে আগের মত সক্ষম ও সক্রিয় করা জরুরি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কাজে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ও জনবল নিয়োগ দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সংবাদপত্র, রেডিও–টিভিতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করতে হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদকে তাদের কার্যক্রমের তালিকায় জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যুক্ত করে ব্যাপক প্রচারণার দায়িত্ব দিতে হবে এবং দেশের সর্বত্র জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মাঠ পর্যায়ের মহিলা কর্মীদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে পাঠিয়ে পূর্বের মত সন্তান জন্মদানে সক্ষম মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য উদ্বুদ্ধ করণের প্রচারণায় নিয়োজিত করতে হবে। (৩) রোহিঙ্গাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলাদা একটি বিভাগ চালু করে কুটনৈতিক পন্থায় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। বিদেশে অবস্থিত আমাদের সকল কুটনৈতিক মিশনকে এ ব্যাপারে বিশ্বজনমত গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিতে হবে। (৪) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যতদিন না তাদের দেশে ফেরত যাচ্ছে ততদিন তাদের বর্তমান শিবির সমূহে কঠোর নজরদারীর মাধ্যমে তাদের গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সন্তান জন্মদানে সক্ষম এমন সকল রোহিঙ্গা নারী–পুরুষকে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও সমাজকর্মী।