শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের জন্য নেভি ব্লু–প্যান্ট, সাদা শার্ট, কালো জুতা ও সাদা মোজা আর শীতকালে এর সঙ্গে যোগ হয় নেভি ব্লু–রঙের সোয়েটার; মেয়েদের জন্য নেভি ব্লু–ফ্রক, সাদা সালোয়ার, সাদা মোজা ও সাদা ওড়না। এ রকম স্কুল ইউনিফর্মের সঙ্গে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। এই ইউনিফর্ম কবে থেকে চালু হয়েছে, কোনো দলিল বা তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। তবে কিছু ইতিহাসবিদদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে ব্রিটেনের স্কুলে প্রথম ইউনিফমের্র রেওয়াজ চালু হয়।
সাদা মানে শুভ্রতা, সাদা মানে আভিজাত্য, সাদা মানে দূরের ঐ সুবিশাল আকাশ। সাদা রঙের পোশাক। হয়তো এ কারণে আমাদের দেশের প্রায় ৯৫% শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেয়েদের স্কুল ড্রেসের পায়জামা সাদা কাপড়ের। সাদার পরিবর্তে অন্য কালারের করা এই জন্য প্রয়োজন যে, সাধারণত মেয়েদের প্রথম পিরিয়ড শুরু হয় ১০ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে আবার অনেকের হয় ৯–১৩ বছর। আমাদের পরিবারগুলোতে এ ব্যাপারে মেয়েদের পিরিয়ডপূর্বক ধারণা দেওয়া হয়ে থেকে। ধরুন, কোনো মেয়ের প্রথম পিরিয়ড ক্লাসে, রাস্তায় বা পাবলিক পরিবহনে হয়, কী অবস্থা হবে। যেহেতু স্কুলের ইউনিফর্ম অনুযাযী পায়জামা সাদা কাপড়ের হয়, তখন সমবয়সীরা সাধারণত ছেলেরা বা উপস্থিত লোকজন এটাকে মজা হিসেবে নিবে বা নিয়ে থাকে। আর মেয়েটির অবস্থা হবে, তার জীবনের পৃথিবীর ভয়ংকর পরিস্থিতির একটি। যেহেতু সাদা কাপড়ে যে কোনো ময়লা বা রং, পিরিয়ডের ব্লিডিং চোখে পড়বে সবচাইতে বেশি। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে, সাদা পায়জামার পরিবর্তে অন্য কোনো রংয়ের পায়জামা ব্যবহার করা খুব জরুরি। স্কুল, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে।
আমাদের দেশে পিরয়ডপূর্বক কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন আছে, তা অনেকে স্বীকার করতে চায় না। কারণ এটাকে এখনো ট্যাবু বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। অথচ বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এটাকে হাস্যরস বানায়। ভুল ব্যাখ্যা দেয়। আপনার হাতের চামড়া যদি প্রতি মাসে ভেঙ্গে গিয়ে খসে খসে পড়া শুরু করে, তাহলে আর কারও কি উচিত হবে আপনার এ দুরবস্থা নিয়ে হাসাহাসি করা? বিশেষ করে শীতে পিরিয়ড কত কষ্টকর একমাত্র নারীরাই জানে। আর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী ভাইয়েরা দয়া করে, এসব ব্যাপারে আমুদিত হয়ে হাসাহাসি করবেন না! এটা খুবই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার! এটা না হলে আপনার আমার এ পৃথিবীতে জন্মই হত না! পিরিয়ডের সময় স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই অস্বস্তিতে থাকে। তার ওপর যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাদা ড্রেস বাধ্যতামূলক হয়, সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস মিস করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষদের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।
স্কুল–কলেজের সাদা পায়জামা বা ড্রেসের পরিবর্তে কালো বা নেভী ব্লু কিংবা গাঢ় রঙের জামাকাপড়ে সুবিধা অনেক। নারীদের পিরিয়ডের সময় ঝামেলায় পরতে হবে না। গরমের সময় ময়লা, ঘাম সহজে বোঝা যায় না। দীর্ঘদিন পড়ার পরও! তবে কতোটা নোংরা হলে তা চারপাশের কেউ ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারে না। সাদা পোশাক নিয়ে সর্বাধিক বিড়ম্বনায় পড়ে শিশুরা। মাত্র এক দিনেই পোশাক ময়লা হয়ে যায়। তারপর সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন ময়লা পোশাক নিয়েই অনেক শিশু ক্লাসে যায়। সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের একাধিক সেট পোশাক থাকলেও তাতে লাভ হয় না।
সাদা কাপড় দু–চার মাস ব্যবহারের পর, আর ধবধবে সাদা আর সাদা থাকে না। শিশুদের ময়লা পোশাকের কারণে অভিভাবকরা অনেক সময় লজ্জায় পড়েন। কিন্তু কত আর ধোয়া যায়! হাইস্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন সময় নষ্ট হয় পোশাক ধোয়ার কাজে। বলপয়েন্টের কালো কালি হচ্ছে সাদা পোশাকের বড় দুশমন। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাদা পোশাকের ছড়াছড়ি চলছে। ছেলেদের শার্ট–প্যান্ট, মেয়েদের জামা–পায়জামা, জুতা–মোজা সবই সাদা। সাদা পোশাক যেন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের পোশাকের রং নিয়ে সরকারি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সর্বত্রই চলছে সাদা পোশাকের যথেচ্ছচার।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি সাদা পোশাকের পরিবর্তে কালো বা নেভী ব্লু কিংবা গাঢ় রঙের পোশাক নির্ধারণ করে, তাহলে অভিভাবকদের তাদের মেয়েদের পিরিয়ড সময়ের দুশ্চিন্তা কমবে, সাবান–পাউডার–লন্ড্রি, পানিসহ আরো অনেক কিছুর সাশ্রয় হবে। প্রতিবছর স্কুলের বই–খাতা–সিলেবাস কত কী বদলায়! এক বছর অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে অন্য পোশাক ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া যায়।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যলেখক